সালতানাত নুকেনোভা
সালতানাত নুকেনোভা

কাজাখস্তানে মন্ত্রী স্ত্রীকে খুনের পর যেভাবে বদলে গেল আইন

স্ত্রীকে হত্যা দায়ে কাজাখস্তানের সাবেক অর্থমন্ত্রী ৪৪ বছর বয়সী কুয়ান্দিক বিশিমবায়েভ দণ্ডিত হয়েছেন। বিচার চলাকালে এই হত্যাকাণ্ডের কিছু সিসিটিভি ফুটেজ আদালতে উপস্থাপনও করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, তিনি তাঁর স্ত্রী সালতানাত নুকেনোভাকে ব্যাপক মারধর করেন, যার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়।

গত ৮ নভেম্বরে এই দম্পতি কাজাখস্তানের সাবেক রাজধানী আলমাতিতে একটি হোটেলে বেড়াতে যান। এটির মালিকানা ছিল কুয়ান্দিকের এক আত্মীয়ের। সেখানে তাঁরা আগের রাত এবং পরের দিন প্রায় পুরোটাই ছিলেন।

আদালতে জমা দেওয়া ফুটেজে দেখা যায়, ঘটনার দিন ৯ নভেম্বর স্থানীয় সময় সকাল সোয়া সাতটার দিকে হোটেলের একটি রেস্তোরাঁয় সালতানাতকে মারধর করছেন, লাথি মারছেন, এমনকি চুল ধরে হেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছেন কুয়ান্দিক। কিন্তু পরবর্তী ১২ ঘণ্টায় ঠিক কী হয়েছে, তা পরিষ্কার নয়। তবে সেই সময়ে কিছু কিছু মুহূর্ত কুয়ান্দিক নিজের মুঠোফোনে ধারণ করেছে। সেগুলোও আদালতে দেখানো হয়েছে, তবে তা সবাইকে দেখানো হয়নি।

জমা দেওয়া নথিপত্রের মধ্যে কিছু অডিও ক্লিপ ছিল, যেখানে কুয়ান্দিককে বারবার সালতানাতকে অপমান করতে শোনা যায়। এমনকি তিনি সালতানাতের কাছে অপর এক ব্যক্তি সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। আরেকটি অডিওতে ছিল কুয়ান্দিক এক জ্যোতিষীকে বেশ কয়েকবার ফোন করেন, সেসব কথা। অথচ তখন তাঁর স্ত্রী ভিআইপিকক্ষে অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলেন। সেখানে কোনো ক্যামেরা ছিল না। রাত আটটার দিকে তিনি একটি অ্যাম্বুলেন্স ডাকেন। ততক্ষণে সালতানাত মারা গেছেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, সম্ভবত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা আগে তাঁর মৃত্যু হয়।

আদালতের কাছে ময়নাতদন্তের বিস্তারিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। সেখানে বলা হয়, মারধর ও আঘাতের কারণে সালতানাতের মস্তিষ্কে ক্ষত সৃষ্ট হয়েছে। এমনকি তাঁর মস্তিষ্কের উপরিভাগ ও খুলির মাঝখানের জায়গা থেকে ২৩০ মিলিলিটার জমাট রক্ত বের করা হয়েছে। তাঁকে শ্বাসরোধ করে হত্যার লক্ষণ পাওয়া গেছে।

যে হোটেলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, সেটির মালিক বাখিতজান বাইজানভকে ঘটনা গোপন করার দায়ে তাঁর চার বছরের কারাদণ্ড হয়। বিচার চলাকালে তিনি দাবি করেন, কুয়ান্দিক তাঁকে সেখানকার ফুটেজগুলো মুছে ফেলতে বলেছিলেন।

১৩ মে কাজাখস্তানের সুপ্রিম কোর্ট ৪৪ বছর বয়সী কুয়ান্দিককে ২৪ বছরের কারাদণ্ড দেন।

কিন্তু কাজাখস্তানে যেখানে শত শত নারী তাঁর সঙ্গীর হাতে খুন হন, সেগুলো বিচার হয় না। জাতিসংঘের হিসাবে, দেশটির পারিবারিক সহিংসতার প্রতি চারটি ঘটনার একটি বিচারের জন্য ওঠে। এখনো অনেক নারী এ বিষয়ে মুখ খুলতে ভয় পায়।

ঘটনার দিনের সিসিটিভি ফুটেজে সালতানাত নুকেনোভা ও কুয়ান্দিক বিশিমবায়েভ

সালতানাতের একমাত্র ভাই আইতবেক আমঞ্জেলডি বলেন, কাজাখের নারীদের এই কান্না অনেক আগে থেকে চলে আসছে। কিন্তু কেউ শুনতে পায়নি।

বিয়ের এক বছর না হতেই কুয়ান্দিকের হাতে সালতানাতকে পৃথিবী ছাড়তে হলো। বিভিন্ন খবরে বলা হয়, ঘুষের দায়ে কুয়ান্দিক ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং ১০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু তিন বছরের কম সময়ের মধ্যে তিনি ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন।

কেমন ছিলেন সালতানাত

সালতানাতের ছোটবেলা কেটেছে রাশিয়া সীমান্তবর্তী পাভলোদার শহরে। স্কুলজীবন শেষে তিনি চলে যান আগের রাজধানী আলমাতিতে। সেখানে তিনি কিছু সময় ভাইয়ের সঙ্গে ছিলেন। ভাই আইতবেক বলেন, ‘সে সময়টা আমাদের জন্য ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তখন আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ ভালোভাবে গড়ে ওঠে। আমাদের ভাই-বোনের মধ্যে যে বন্ধন সে সময় গড়ে উঠেছিল, তা আজীবন আমাদের মধ্যে ছিল।’

বিয়ের আগের সময়টা সালতানাত জ্যোতিষী হিসেবে কাজ করছিলেন। দাদির কাছ থেকে পাওয়া এক উপহারের বই পড়ে তিনি এই দিকে ঝুঁকেছিলেন।

উচ্ছল, হাসিখুশি বোনের স্মৃতিচারণা করে আইতবেক বলেন, যেসব নারী পারিবারিক সম্পর্ক, বিয়ে, সন্তান নিয়ে নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতেন, তাঁদের সাহায্য করতেন সালতানাত। তাঁর স্বপ্ন ছিল জ্যোতিষ বিদ্যা নিয়ে একটি স্কুল খোলা।

আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আইতবেক বলেন, কুয়ান্দিক তাঁর বোন সালতানাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য সময় চাইছিলেন। কিন্তু সালতানাত না করে দিয়েছিলেন।

কিন্তু কুয়ান্দিক নাছোড়বান্দার মতো লেগেছিলেন। তিনি সালতানাতের ফোন নম্বর জোগাড় করেন।

আদালতে বিচার চলাকালে কুয়ান্দিক বিশিমবায়েভ

আইতবেক বলেন, কুয়ান্দিক সালতানাতকে যত খুদে বার্তা পাঠাতেন, সে তাঁকে সব দেখাত। সেসব বার্তায় কুয়ান্দিক সালতানাতের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ার কথা লিখেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর সম্পর্কে মানুষ যা লিখেছে বা বলে, সেগুলো যাতে বিশ্বাস না করে, সেই অনুরোধ করেছিলেন।

এরপর দুজনের দেখা হওয়ার এক মাসের মধ্যে তাঁরা বিয়ে করেন। আর তাঁদের মধ্যে বিবাদ শুরু হতেও বেশি দেরি হয়নি। সালতানাতকে যে কুয়ান্দিক আঘাত করেছে, সেসব ছবিও বোন তাঁকে বেশ কয়েকবার দেখিয়েছেন। এমনকি তাঁর বোন কুয়ান্দিককে অনেকবার ছেড়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেছে।

কুয়ান্দিক তাঁর স্ত্রী সালতানাতকে কাজ ছাড়তে বাধ্য করেন। ধীরে ধীরে তাঁকে একা করে দিচ্ছিলেন।

বিচারক বলেছেন, নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে আদালত কুয়ান্দিককে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। সালতানাতকে নির্মমভাবে আঘাত করার কথা স্বীকার করেছেন কুয়ান্দিকও। তবে তিনি দাবি করেছেন, এই হত্যাকাণ্ড তাঁর ইচ্ছাকৃত ছিল না। আদালতকে তিনি ‘ন্যায়বিচার’ করার আরজি জানান।

একটি সাহসী উদ্যোগ

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পূর্ব ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়াবিষয়ক উপপরিচালক ডেনিস ক্রিভোশিভ বিবিসিকে বলেন, বেঁচে থাকা নারীকে (নির্যাতনের শিকার) হয়তো দোষারোপ করা হতে পারে, তিনি পরিবারকে ধ্বংস করে দিয়েছেন, স্বামী বা শ্বশুর-শাশুড়িকে অসম্মান করেছেন। এসবই তাঁর স্বামীকে ‘উসকে’ দেয়।

ডেনিস ক্রিভোশিভ আরও বলেন, পারিবারিক সংহিতা নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হওয়া সাহসের বিষয়। এই দেশে অহরহ এমন ঘটনা ঘটে, কিন্তু সেগুলো সামনে না আসার পেছনে অনেক কারণও আছে।

বাস্তবতা হলো, এই সহিংসতা যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত, এখনো সেভাবে দেখা হয় না।
দিনারা স্মাইলোভা, নেমোলচিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা

জাতিসংঘের হিসাবে প্রতিবছর কাজাখস্তানে প্রায় ৪০০ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা যান। আর ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলসে এই সংখ্যা ৭০। অথচ গত বছরের মার্চের হিসাবে তাদের জনসংখ্যা কাজাখস্তানের তুলনায় তিন গুণ বেশি।

কাজাখস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে দেশটিতে পারিবারিক সহিংসতার শিকার ব্যক্তিদের জন্য কাজ করা সহায়তা কেন্দ্রে (ক্রাইসিস সেন্টার) কল আসার সংখ্যা ১৪১ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে।

তা স্বত্ত্বেও ক্রিভোশিভ বলেন, এখনো এখানে পারিবারিক সহিংসতা মুখ বুজে সয়ে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি, কবে এটি কমে আসছে।

কিন্তু সালতানাত হত্যার বিচারপ্রক্রিয়া আদালতকক্ষ থেকে সরাসরি দেখানোর ফলে সরকারের ওপর ব্যাপক চাপ তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা এ নিয়ে বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে কথা বলতে শুরু করেন। এমনকি পারিবারিক সহিংসতা নিরসন আইন সংস্কারের দাবি জানিয়ে একটি আবেদন করা হয়। সেখানে দেড় লাখের বেশি মানুষের সই করেছিলেন।

জাতিসংঘের হিসাবে প্রতিবছর কাজাখস্তানে প্রায় ৪০০ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়ে মারা যান।

১৫ এপ্রিল কাজাখস্তানের প্রেসিডেন্ট কাসিম জোমার্ত তোকায়েভ একটি বিলে সই করেন। সেখানে পারিবারিক সহিংসতার দায়ে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। ২০১৭ সালে করা সেই আইনটি ছিল অফৌজদারি। আর নতুন ‘সালতানাত’স আইনে এটিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ধরনের ঘটনায় ভুক্তভোগী এখন নিজে অভিযোগ না জানালেও অন্যরা এ নিয়ে মামলা করতে পারবে।

কিন্তু দিনারা স্মাইলোভা বলেন, ‘কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই সহিংসতা যতটা গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত, এখনো সেভাবে দেখা হয় না।’ দিনারার প্রতিষ্ঠান নেমোলচিক ফাউন্ডেশন পারিবারিক সহিংসতা ও ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তায় কাজ করে।

দিনারা বলেন, কোনো নারী যদি আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি না হয় বা সেখানে ২১ দিন না থাকে, তাহলে সেই আঘাতকে গুরুতর হিসেবে মনে করা হয় না। হাত-পা ভেঙে দেওয়া, নাক ও চোয়াল ফাটিয়ে দেওয়াকে ছোটখাটো ক্ষতি বলে গণ্য করা হয়।

কুয়ান্দিক বিশিমবায়েভ বিচার চলাকালে বলেন, তিনি ইচ্ছে করে সালতানাতকে হত্যা করেননি

দিনারা কৈশোরে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার নিজের অভিজ্ঞতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন। এতে তিনি ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলেন। কয়েক দিনের মধ্যে শতাধিক নারী তাঁকে লিখে জানিয়েছেন, তাঁরাও একই ধরনের অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। কীভাবে তাঁদের চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আর অপরাধীরা শাস্তির বাইরে রয়ে গেছে। এরপরই দিনারা এই নিজের প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন।

দিনারার প্রতিষ্ঠানটি গত আট বছর ধরে এ ধরনের সহিংসতার কথা প্রকাশ করে যাচ্ছে। তবে দিনারা দীর্ঘদিন ধরে কাজাখস্তানের বাইরে থাকছেন। কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে দেশে হুলিয়া জারি করা হয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধে দেশটির মিথ্যা তথ্য ছাড়ানো, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন ও প্রতারণার অভিযোগ আনা হয়েছে।

আইতবেক বলেন, সালতানাত সব সময় ন্যায়ের জন্য লড়েছেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে, এটা ব্যাপার নয়...ন্যায়বিচারের প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন। যখনই তিনি দেখেছেন কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং তাঁর সাহায্য প্রয়োজন, তিনি তখনই তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন।

আইতবেক বলেন, ‘আইনটির ব্যবহার এখনো সেভাবে হয়নি..তারপরও শুরু তো হলো। মানুষ দেখতে পেল, অনেক ক্ষমতাধর মানুষেরও এ আইনে শাস্তি হতে পারে। এই বিচার মানুষকে দেখাবে, কাজাখস্তানে আইন সবার জন্য সমান এবং বিচারের কাঠগড়ায় আইনের চোখে সবাই সমান।’