মালয়েশিয়ার সাধারণ নির্বাচনে কোনো জোটই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এ কারণে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঝুলন্ত পার্লামেন্ট পায় দেশটি। সরকার গঠন নিয়ে একের পর এক নাটকীয় মুহূর্তের পর শেষ পর্যন্ত মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন আনোয়ার ইব্রাহিম। এর মধ্য দিয়ে বিরোধী নেতা হিসেবে তাঁর দুই দশকেরও বেশি সময়ের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে।
তবে আনোয়ার ইব্রাহিম এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন, যা নেতা হিসেবে তাঁর দক্ষতাকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলবে। জাপানের গণমাধ্যমে নিক্কেই এশিয়ায় লেখা এক কলামে এমনটাই মনে করছেন কুয়ালালামপুরভিত্তিক মালয়েশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিক রিসার্চের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শংকরন নাম্বিয়ার। পাঠকের জন্য তা তুলে ধরা হলো—
মালয়েশিয়ার রাজনৈতিক পরিমণ্ডল যতটা সম্ভব বিভক্ত। আনোয়ার একটি জাতীয় ঐক্যের সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাঁকে নির্ভর করতে হবে একসময়ের শত্রু বারিসান ন্যাসিওনাল ও অন্য দলগুলোর সমর্থনের ওপর।
গত চার বছরের মধ্যে আনোয়ার হলেন মালয়েশিয়ার পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতার জন্য দলগত দ্বন্দ্ব ২০২০ ও ২০২১ সালের জোট সরকারের পতন ঘটায়। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া পাকাতান হারাপানের জন্য আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আনোয়ারকে স্বস্তি দেবে না। প্রায় সব পূর্বাভাসে বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনীতি একটি মারাত্মক স্থবিরতার দিকে ধাবিত হতে পারে। অনেক দেশই মন্দার কবলে পড়তে পারে। মালয়েশিয়াও এ পরিস্থিতি থেকে বাদ পড়বে না। যদিও দেশটির অর্থনীতির আকার সামান্য হলেও বাড়বে, তবু সম্ভবত অনেকটা মন্দার মতো একটি পরিস্থিতি এটি অনুভব করবে।
মালয়েশিয়া মূল্যস্ফীতির চাপ, অব্যাহতভাবে রিঙ্গিতের মান কমে যাওয়া এবং বয়স্ক হতে শুরু করেছে—এমন জনসংখ্যার চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। অবকাঠামোগত সমস্যাগুলোও দেশটির দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। অবনতিশীল শিক্ষার মান, অপর্যাপ্ত উচ্চ মেধার শ্রমিকের জোগান, অপর্যাপ্ত পরিমাণে উৎপাদন এবং দেশটির মধ্যম আয়ের ফাঁদে পড়ার মতো বিষয়গুলোও মোকাবিলা করতে হবে।
আনোয়ার তাঁর আদর্শবাদ, সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়তা এবং সংস্কারের মানসিকতার জন্য পরিচিত। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ এবং বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যের সরকার তাঁর কাজের ক্ষেত্রকে সীমিত করবে।
আনোয়ার নিজের জন্য উচ্চমান নির্ধারণ করেছেন। তিনি তাঁর নির্বাচনী জোট পাকাতান হারাপানের ব্যাপকতর ও উচ্চাভিলাষী ইশতেহার দ্বারা বিবেচিত হবেন। নির্বাচনী প্রচারণায় তাঁর জোট মানবিক অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দেশটির বুড়িয়ে যাওয়া সমাজের সমস্যা সমাধান ও বিনিয়োগ টানার মতো বিষয় মোকাবিলার কথা বলেছে। অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে রয়েছে—জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরা, দারিদ্র্য বিমোচন, সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন।
আনোয়ার তাঁর আদর্শবাদ, সুশাসন ও গণতন্ত্রের প্রতি দৃঢ়তা এবং সংস্কারের মানসিকতার জন্য পরিচিত। কিন্তু অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চ্যালেঞ্জ এবং বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক পক্ষের সমন্বয়ে গঠিত ঐক্যের সরকার তাঁর কাজের ক্ষেত্রকে সীমিত করবে।
গত চার বছরের মধ্যে আনোয়ার হলেন মালয়েশিয়ার পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী। ক্ষমতার জন্য দলগত দ্বন্দ্ব ২০২০ ও ২০২১ সালের জোট সরকারের পতন ঘটায়। ক্ষমতার এই দ্বন্দ্ব নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়া পাকাতান হারাপানের জন্য আরও বেশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।
অর্থনীতি পরিচালনা করা কম কঠিন হবে না। করোনাভাইরাস মহামারি মালয়েশিয়ার পর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষেত্রকে সংকুচিত করেছে। আগামী বছর প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিবেশ দেখা দিতে পারে। এর ফলে অতিরিক্ত সরকারি ব্যয় কমানোর সুযোগ হবে না।
বৈশ্বিক ক্ষেত্রও মালয়েশিয়ার অর্থনীতিকে চাঙা করার পক্ষে অনুকূল হবে না।
আনোয়ার ইব্রাহিমকে অবশ্যই পরবর্তী বাজেটের দিকে শিগগিরই নজর দিতে হবে। বিগত সরকার এ বাজেট পেশ করেছিল। কিন্তু পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ায় তা আর পাস হয়নি। এ বাজেটের পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। কারণ, নির্বাচনী বাজেট থাকায় এতে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চেয়ে গোষ্ঠীস্বার্থ বেশি দেখা হয়েছে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
সামনের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় আনোয়ারের অর্থমন্ত্রী বাছাই হবে গুরুত্বপূর্ণ। ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) জোটের প্রধান দল বারিসান ন্যাসিওনাল দলের জোহারি আবদুল গনি এই পদের জন্য উপযুক্ত হতে পারেন। এতে নতুন সরকারের প্রতি তাঁর জোটের অঙ্গীকারও পোক্ত হবে।
মালয়েশিয়ার ইতিহাসের এ পর্যায়ে দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই লড়াইয়ের সময় দেশটিকে আসন্ন জটিল অবস্থা থেকে বের করে আনতে আনোয়ারকে সবচেয়ে ভালোভাবেই প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
জোহারির ব্যবসায়িক জায়গা থেকে উঠে আসা। আগে তিনি উপ-অর্থমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। বাজার কীভাবে কাজ করে, সে সম্পর্কে তিনি ভালো ধারণা রাখেন। জোহারিও সংস্কারের বিষয়ে আন্তরিক। আনোয়ারের মতো তিনিও বৈচিত্র্য ও বহুত্ববাদকে গুরুত্ব দেন।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে আনোয়ারের নিজেরও অভিজ্ঞতা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের অধীন ১৯৯১ থেকে ১৯৯৮ সাল নাগাদ তিনি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওই সময় অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল মালয়েশিয়া। আনোয়ার ও জোহারির অতীত অভিজ্ঞতা শক্তিশালী অর্থনৈতিক টিম গঠনে সহায়ক হতে পারে।
মালয়েশিয়ার ইতিহাসের এ পর্যায়ে দেশটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি প্রভাবশালী মধ্যম শক্তি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এই লড়াইয়ের সময় দেশটিকে আসন্ন জটিল অবস্থা থেকে বের করে আনতে আনোয়ারকে সবচেয়ে ভালোভাবেই প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে।
মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রয়োজন। দেশটির অর্থনীতিকে রূপান্তরে দরকার আরও উদার ও দূরদর্শী পদক্ষেপ। সংস্কারের মানসিকতার বিষয়টি বিবেচনায় নিলে আনোয়ারই এ মুহূর্তে মালয়েশিয়ার সেরা বাজি।