গণবিক্ষোভে টালমাটাল শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন প্রবীণ রাজনীতিক রনিল বিক্রমাসিংহে। আজ বুধবার পার্লামেন্ট সদস্যদের (এমপি) ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসা বিক্রমাসিংহে। ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে ১৩৪ ভোট পেয়েছেন ছয়বারের এই প্রধানমন্ত্রী।
নজিরবিহীন আর্থিক সংকটে পড়া শ্রীলঙ্কায় গত কয়েক মাস ধরে গণ-অসন্তোষ চলছে। খাদ্য ও জ্বালানি সংকটে জনগণ রাজপথে নেমে আসলে একে একে পতন ঘটতে থাকে রাজাপক্ষে শাসক পরিবারের সদস্যদের। দুই দশক ধরে দ্বীপরাষ্ট্রটির রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আসছিল পরিবারটি।
গণবিক্ষোভের মুখে মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও বাসভবন ছেড়ে পালালে শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দৃশ্যপটে ফেরেন ৭৩ বছর বয়সী বিক্রমাসিংহে। বর্তমান পার্লামেন্টে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির (ইউএনপি) একমাত্র প্রতিনিধি রনিল বিক্রমাসিংহে। অথচ চলমান সংকটে ঘুরেফিরে প্রধানমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হলেন তিনি।
মাহিন্দা পদত্যাগ করলে ষষ্ঠবারের মতো শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গত ১২ মে শপথ নেন বিক্রমাসিংহে। প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে তাঁকে শপথ পড়িয়েছিলেন। গণরোষে সেই গোতাবায়া দেশ ছেড়ে পালালে ১৫ জুলাই ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন বিক্রমাসিংহে।
গত নির্বাচনে বিক্রমাসিংহের দলের ভরাডুবি হয়। এরপর শ্রীলঙ্কার রাজনীতি থেকে অনেকটা হারিয়ে যেতে বসেছিলেন তিনি। তাঁর এই ভাগ্য ফেরার নেপথ্যে মূলত রাজাপক্ষে পরিবারের আনুকূল্য। কারণ, পার্লামেন্টে এখনো রাজাপক্ষেদের দল শ্রীলঙ্কান পদুজনা পেরামুনা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কার্যত তিনি তাঁদের প্রার্থী ছিলেন।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য অনেক নেতার মতোই রাজনৈতিক পরিবার থেকে এসেছেন বিক্রমাসিংহে। তাঁর চাচা জুনিস জয়াবর্ধনে এক দশকের বেশি সময় শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৭৭ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিক্রমাসিংহে। সে সময় প্রেসিডেন্ট ছিলেন জুনিস জয়াবর্ধনে। ওই সরকারেই সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হন তিনি।
তামিল গেরিলাদের হাতে সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসা নিহত হওয়ার পর ১৯৯৩ সালে প্রথমবার শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হন বিক্রমাসিংহে। সেবার মাত্র এক বছরের কিছু বেশি সময় ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।
ছয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনোবারই মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি বিক্রমাসিংহে। শেষবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দুই মাসের মাথায় ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। পাঁচ হাজার কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণের দায়ে ঋণখেলাপি একটি দেশের দায়িত্ব নিলেন বিক্রমাসিংহে।
অভিজ্ঞ এই রাজনীতিককে পশ্চিমাপন্থী বাজার সংস্কারবাদী হিসেবে মনে করা হয়। অর্থনৈতিক সংকটে ডুবতে বসা শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সহায়তা (বেল আউট তহবিল) এনে দিতে তাঁকে সম্ভাব্য আলোচক হিসেবেও মনে করা হচ্ছে।
সাবেক আইনজীবী রনিল বিক্রমাসিংহে একসময় সাংবাদিকও হতে চেয়েছিলেন। এএফপিকে তিনি বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালে সংবাদপত্রের পারিবারিক ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা না হলে সম্ভবত তিনি সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতেন।
রনিল বিক্রমাসিংহে গত দুটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়াই করে হেরে গেছেন। দলকে টানা পরাজয় উপহার দেওয়ায় খোদ সমর্থকেরাও তাঁকে ‘রেকর্ড লুজার’ বলে আখ্যা দেন।
সংকটের মারপ্যাঁচে এবার প্রেসিডেন্ট হলেন বিক্রমাসিংহে। নির্বাচিত হওয়ার পর পার্লামেন্টে ভাষণে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের মধ্যে এখন আর কোনো বিভক্তি নেই।’
তবে নতুন প্রেসিডেন্ট বিভক্তি অবসানের কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। আল-জাজিরাকে বিক্ষোভকারীদের নেতা মেলানি গুনাথিলাকে বলেছেন, ‘রনিল বিক্রমাসিংহে পদত্যাগ না করা পর্যন্ত “গোতাগোগামা”য় (বিক্ষোভস্থল) নিশ্চিতভাবে আমাদের সংগ্রাম এবং অবস্থান কর্মসূচি আমরা চালিয়ে যাব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ভালো করেই জানি, গোতাবায়া আর রনিল বিক্রমাসিংহে একই লোক নন। তিনি (বিক্রমাসিংহে) আরও ধূর্ত লোক। সম্প্রতি তিনি জরুরি অবস্থা জারি করে বিক্ষোভ দমনের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন।’
বিক্রমাসিংহের বিরুদ্ধে রাজাপক্ষেদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগ পুরোনো। তাঁদের সমর্থনেই মূলত তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। এ কারণে শ্রীলঙ্কা নতুন প্রেসিডেন্ট পেলেও দেশটির পরিস্থিতি সহসা শান্ত হবে বলে মনে হচ্ছে না।