সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমার। ৩ জুলাই, ২০২১
সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ। ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমার। ৩ জুলাই, ২০২১

মিয়ানমার থেকে কোটি কোটি ডলার আয় করছে যুক্তরাষ্ট্র–যুক্তরাজ্যের কোম্পানিগুলো

মিয়ানমারে দুই বছর আগে ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থান হয়। অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। এই জান্তা সরকারের সময় মিয়ানমার থেকে বিশ্বের বড় বড় জ্বালানি তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো কোটি কোটি ডলার কামাচ্ছে। আয়ের বিপরীতে এসব কোম্পানির দেওয়া করসংক্রান্ত নথি হাতে এসেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’–এর কাছে। এসব নথিতে জান্তার সঙ্গে ব্যবসা করে পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর মুনাফার বিষয়টি উঠে এসেছে।

জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টিয়ারের ভাষ্য অনুযায়ী, সামরিক জান্তারা ক্ষমতা দখলের পর ‘মিয়ানমারে প্রতিদিন যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে’। পর্যবেক্ষক সংগঠন অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারসের হিসাবে, গত দুই বছরে ২ হাজার ৯৪০ জন নিহত হয়েছে। এর মধ্যে শিশু, সাধারণ মানুষ ও গণতন্ত্রপন্থী অধিকারকর্মীরা রয়েছেন। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর দমন–পীড়নে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন কয়েক লাখ মানুষ।

একদিকে যখন নিরাপত্তা বাহিনীর এমন সহিংসতা চলছে, তখন অন্যদিকে কোটি কোটি ডলার কামাচ্ছে পশ্চিমা তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো। মিয়ানমারের কর নিয়ে ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা যাচ্ছে, সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারে কোটি কোটি ডলার কামানো তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ঠিকাদারের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডের।

যা জানা গেল  
এসব নথি সংগ্রহ করেছে ডিস্ট্রিবিউটেড ডিনায়্যাল অব সিক্রেটস নামের একটি অলাভজনক সংস্থা। এটিকে উইকিলিকসের ‘উত্তরসূরি’ বলা হয়ে থাকে। নথিগুলো বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা করেছে মিয়ানমারের মানবাধিকার সংস্থা জাস্টিস ফর মিয়ানমার, অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন ফাইন্যান্স আনকাভারড ও গার্ডিয়ান।

মিয়ানমারে ব্যবসা করলে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়তে হবে জানিয়ে গত বছরের জানুয়ারিতে সতর্ক করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরপরও সে দেশে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় তেল–গ্যাস কোম্পানির কিছু অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারের সরকারি এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে, যাদের থেকে সরাসরি উপকৃত হচ্ছে জান্তারা। এর মধ্যে একটি হলো মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজ (এমওজিই)।

মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান বিক্ষোভকারীদের

গত মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা মিয়ানমারের ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। নতুন এ নিষেধাজ্ঞার তালিকায় এমওজিইর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও উপব্যবস্থাপনা পরিচালকও (ডিএমডি) আছেন। তবে শীর্ষ নির্বাহীদের নিষেধাজ্ঞা দিলেও প্রতিষ্ঠানটির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হচ্ছে না।

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে প্রথম কোনো দেশ/জোট হিসেবে মিয়ানমার অয়েল অ্যান্ড গ্যাস এন্টারপ্রাইজের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। কারণ হিসেবে ইইউ জানায়, মিয়ানমারে একের পর এক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং এসব দমন–পীড়নে জান্তার অর্থের উৎস হয়ে উঠেছে এমওজিই।

ইইউয়ের এ নিষেধাজ্ঞার কারণে জোটে থাকা দেশের কোম্পানিগুলো মিয়ানমারের তেল ও গ্যাসক্ষেত্র প্রকল্পে কাজ করতে পারবে না। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখনো এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।

অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর থেকে মিয়ানমারের জান্তা সরকার বিরোধী মত দমনে সব ধরনের তৎপরতা চালায়

ফাঁস হওয়া নথিতে যা আছে
যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান তেল কোম্পানি হ্যালিবার্টনের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান মিয়ানমার এনার্জি সার্ভিসেস। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে মিয়ানমারে ৬৩ লাখ ডলার মুনাফা করে। এ মুনাফার মধ্য থেকে কর পরিশোধ করা হয়। এ ৯ মাসের মধ্যে জানুয়ারি ছাড়া আট মাস ক্ষমতায় ছিল সামরিক জান্তা।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক তেল কোম্পানি বেকার হাগস। মিয়ানমারের প্রধান শহর ও একসময়কার রাজধানী ইয়াঙ্গুনে বেকার হাগসের শাখা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত কর পরিশোধ করার আগে মিয়ানমারে এই প্রতিষ্ঠানের মুনাফা ছিল ২৬ লাখ ৪০ হাজার ডলার।    

যুক্তরাষ্ট্রের তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান কোম্পানি ডায়মন্ড অফশোর ড্রিলিং ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে মিয়ানমারের শুল্ক কর্তৃপক্ষকে ৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ফি পরিশোধ করে। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে পরের ছয় মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত সময়ে আরও ২ কোটি ৪২ লাখ ডলার দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সর্ববৃহৎ অফশোর ড্রিলিং কোম্পানি শ্ল্যামবেজ। এই কোম্পানির একটি শাখা আছে মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরে। পানামা থেকে এ অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। ফাঁস হওয়া কর নথিতে দেখা যায়, ২০২১ সালের প্রথম ৯ মাসে প্রতিষ্ঠানটি মিয়ানমার থেকে ৫ কোটি ১৭ লাখ ডলার আয় করে।

মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছে দেশটির তরুণ প্রজন্ম

পরিস্থিতি ‘শোচনীয়’
মিয়ানমারের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ তেল ও গ্যাস প্রকল্পের বেশির ভাগ মালিকানা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এমওজিইর। এসব প্রকল্প থেকে সরকারের হয়ে প্রতিষ্ঠানটি কর ও অন্যান্য ফি আদায় করে। সামরিক জান্তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় উৎস তেল ও গ্যাস। সরকারি হিসাবে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়ে এ খাত থেকে ১৭২ কোটি ডলার আয় হয়েছিল।

সামগ্রিক এই পরিস্থিতিকে শোচনীয় বলে বর্ণনা করেন মানবাধিকার সংস্থা জাস্টিজ ফর মিয়ানমারের মুখপাত্র ইয়াদানার মাউং। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে কাজ করা তেল কোম্পানিগুলো হাতে রক্তের দাগ নিয়ে এমন একটি শিল্প খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, যাতে উপকৃত হচ্ছে মিয়ানমারের অবৈধ জান্তা সরকার।’

অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনারসের হিসাবে, গত দুই বছরে ২ হাজার ৯৪০ জন নিহত হয়েছে

ইয়াদানার মাউং বলেন, ‘সাধারণ মানুষের ওপর সন্ত্রাসীদের মতো দমনাভিযান চালাচ্ছে জান্তা। এসব কোম্পানি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানবাধিকারের বিষয়টি ভুলে তাদের সঙ্গেই ব্যবসা করছে। জান্তার নৃশংসতায় অর্থায়নের মাধ্যমে তাদের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠানকেও অভিযুক্ত করা যায়।’

মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, অভ্যুত্থানের পরও পশ্চিমা যেসব কোম্পানি জান্তাদের সঙ্গে কাজ করছে, তাদেরও জান্তার এসব অপরাধের সঙ্গে জড়িত বলা যায়। কারণ, সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। আইন বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা আবার বলছেন, ভবিষ্যতে এসব প্রতিষ্ঠান নিজ দেশে আইনি সমস্যায় পড়তে পারে।