গত বছরের শুরুতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করে। এরপর সেনাদের হাতে কয়েক হাজার মানুষ নিহত বা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এসব ঘটনার আগে বেশ শান্তিতেই জীবনযাপন করছিলেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর দাওয়েইর বাসিন্দা হিনিন সি। তখন তিনি অফিসে যেতেন, সাপ্তাহিক ছুটিতে তাঁর সাইকেল নিয়ে প্রকৃতি দেখতে বেরোতেন, না হলে বন্ধুরা মিলে আন্দামান সাগর–তীরবর্তী পাহাড়ে উঠতেন। সেদিন আর নেই।
সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই মিয়ানমারে শুরু হয় গণ–আন্দোলন। এই গণ–আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেশটির তরুণেরা। সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনকারীদের দমনে উঠেপড়ে লাগে জান্তা কর্তৃপক্ষ। জান্তার প্রধান লক্ষ্যবস্তু হয়ে দাঁড়ায় তরুণেরা। তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযান চলে, ধরপাকড় হয়। শত শত তরুণ নিহত হয়েছেন। অভ্যুত্থানের পর এমনিতেই দেশটির অর্থনীতি পতনের মুখে, নতুন পরিস্থিতিতে তাঁদের শিক্ষার স্বপ্নও এখন সুদূরপরাহত। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। তরুণেরা বনে–জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন, কাঁধে তুলে নিয়েছেন অস্ত্র। এত কিছুর পরেও এই তরুণেরাই এখনো মিয়ানমারে স্বৈরশাসনবিরোধী বিক্ষোভ চালাচ্ছেন।
স্থানীয় পর্যবেক্ষক প্রতিষ্ঠান দ্য অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্সের (এএপিপি) যুগ্ম সম্পাদক কো বো কিই বলেন, ‘জান্তা কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক তরুণকে তাদের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে।’ প্রতিষ্ঠানটির হিসাবে, অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভে সেনাবাহিনীর অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০০–এর বেশি মানুষের বয়স ১৬ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এ ছাড়া একই বয়সের ২ হাজার ৮০০–এর বেশি মানুষ মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন।
কো বো বলেন, ‘তরুণেরা দেশের ভবিষ্যৎ। কিন্তু সেনাবাহিনী তাঁদের আটক, নির্যাতন ও হত্যা করছে। দেশকে ধ্বংস ও দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে দিচ্ছে।’
অভ্যুত্থানের পর থেকে মিয়ানমারের দক্ষিণ সীমান্তের তানিনথারি অঞ্চলে সংঘবব্ধ হতে শুরু করেন তরুণেরা। স্থানীয় সশস্ত্র প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন তাঁরা। সেখানকার আটজন তরুণের সাক্ষাৎকার নিয়েছে আল–জাজিরা। তাঁরা বলেছেন, বড় ও ছোট শহরগুলোয় তরুণদের দেখা পাওয়া যায় না। কারণ, বেশির ভাগ তরুণ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন, নয়তো এমন স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন, যেসব এলাকা প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। অনেকে আবার প্রতিরোধযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। আর সেনা–নিয়ন্ত্রিত এলাকায় তরুণেরা আছেন ভয় আর শঙ্কা নিয়ে।
হিনিন সির বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। অভ্যুত্থানের পর শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ করছিলেন তিনি। সরকারি কর্মচারীদের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য তহবিল সংগ্রহের লক্ষ্যে ফেসবুকে একটি পেজও খুলেছিলেন গণতন্ত্রপন্থী এই নারী।
কিন্তু এখন আর কিছুই করতে পারছেন না। ঘরের বাইরে তেমন একটা যেতে পারেন না, লিখতে পারেন না অনলাইন মাধ্যমে। সম্প্রতি এক বন্ধুর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন হিনিন। প্রতিরোধযোদ্ধাদের সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর লড়াইয়ে অনেক মানুষ ঘরছাড়া হয়েছেন। তাঁদের সাহায্য করায় তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী গ্রেপ্তার হয়েছেন জানার পর বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি চলে যান তিনি।
হিনিন সি বলেন, ‘আমাদের, তরুণদের এখন মনে হচ্ছে, আমরা এখানে এসে আটকে গেছি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে একধরনের নিরাশা তৈরি হয়েছে।’
আল–জাজিরাকে সাক্ষাৎকার দেওয়া তরুণদের মধ্যে বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া একজন ছাড়া কেউই তাঁদের প্রকৃত নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ তাঁদের ডাকনাম বা ছদ্মনাম ব্যবহার করতে বলেন। সেনাবাহিনীর প্রতিশোধের শিকার যাতে না হতে হয়, সে কারণে এমন অনুরোধ করেন তাঁরা।
‘কোথাও নিরাপদ নয়’
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের কয়েক দিন পরেই মিয়ানমারে শান্তিপূর্ণভাবে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। কিন্তু এপ্রিলে এসে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র শত শত বিক্ষোভকারীকে ছত্রভঙ্গ করতে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। অথচ হাতে অস্ত্র তুলে না নিয়ে সাধারণ মানুষকে নিয়ে এ বিক্ষোভ শুরু করেছিলেন তরুণেরা।
সেনাবাহিনীর দমনাভিযান শুরুর পর লোকজন বিপ্লবী কৌশল অবলম্বন করেন। তখন সেনাবাহিনী তাঁদের ছত্রভঙ্গ করার পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করার চেষ্টা চালায় যে অভ্যুত্থানের যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁদের জন্য যেন নিরাপদ কোনো জায়গা না থাকে। যাঁদের অভ্যুত্থানবিরোধী মনে হয়, তাঁদের বাসাবাড়িতে অভিযান চালাতে শুরু করেন সেনা ও পুলিশ সদস্যরা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাঁরা এ–ও যাচাই করতে শুরু করেন যে সেসব বাড়িতে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের নাম কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে কি না।
এখানেই শেষ নয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা এবার যাঁরা আত্মগোপনে গেছেন, তাঁদের বের করে আনার কৌশল হিসেবে তাঁদের পরিবারের সদস্য ও সহযোগীদের পিছু নেন।
এএপিপির তথ্য অনুযায়ী, এ লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের পর থেকে ৪৫০ জনের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই প্রবীণ, নয়তো কম বয়সী শিশু।
নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় যাঁকে পান, তাঁকে থামাতে শুরু করেন। থামিয়ে মুঠোফোনে বিভিন্ন তল্লাশি করে খুঁজে দেখেন, প্রতিরোধ আন্দোলনের সমর্থনে তাঁদের মুঠোফোনে কোনো প্রমাণ আছে কি না। তল্লাশিচৌকিতে নিরাপত্তা বাহিনীর বাধা না মেনে চলে যাওয়ায় অন্তত সাতজনকে সরাসরি গুলি করার ঘটনা ঘটে।
অনলাইনে লেখালেখি করার বিষয়টিও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক সংবাদমাধ্যম রেডিও ফ্রি এশিয়ার হিসাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও সন্ত্রাসবাদে উসকানি’ দেওয়ার অভিযোগে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা দুই শতাধিক গণতন্ত্রপন্থী কর্মীকে গ্রেপ্তার করেন। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়নের অভিযোগে এর মধ্যে সাতজনকে ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেনাদের অভিযোগ, এই অর্থ সশস্ত্র গোষ্ঠীকে দেওয়া হয়েছে।
গত আগস্টে তানিনথারিতে সশস্ত্র যোদ্ধা ও সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। এর পর থেকে নাটকীয়ভাবে অঞ্চলটির নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এ মাসে স্থানীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউদার্ন মনিটরের প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, সামরিক বাহিনীর হাতে গুলিবিদ্ধ, গ্রেপ্তার ও নিপীড়নের ঘটনা বাড়ছেই।
বিক্ষোভ থামেনি
সামরিক বাহিনীর হাতে ইতিমধ্যে ২ হাজার ২০০–এর বেশি মানুষের প্রাণহানি এবং ১৫ হাজারের বেশি মানুষ গ্রেপ্তার হলেও গণতন্ত্রপন্থীদের সেই বিক্ষোভ এখনো চলছে। বিক্ষোভাকারী কিছু কিছু গোষ্ঠী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভের আয়োজন করছে।
তাতিনথারির লংগোলন শহরে অভ্যুত্থানবিরোধী বিক্ষোভকারীদের নেতা রেমন্ড। প্রতি সপ্তাহে একাধিক বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিচ্ছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছি।’
অভ্যুত্থানের আগে রেমন্ড পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এখন গ্রেপ্তার এড়াতে প্রতিদিন পালিয়ে বেড়ান। স্থানীয় মানুষজনের দেওয়া তহবিল দিয়ে বিক্ষোভের আয়োজন করা হয়। কিন্তু এখন নিত্যপণ্যের দাম আকাশচুম্বী।
দেশটির মুদ্রা কিয়াতের মান কমে গেছে। অর্থনীতিও পতনের দিকেই যাচ্ছে। ফলে মুঠোফোনে ইন্টারনেট সংযোগ নেওয়ার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন, তারও জোগান পাচ্ছেন না বিক্ষোভকারীরা। এমনকি দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার মতো অর্থও তাঁদের কাছে থাকছে না। সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে এরই মধ্যে প্রায়ই তাঁদের বিভিন্ন বনজঙ্গলে আত্মগোপনে থেকে দিনের পর দিন কাটাতে হচ্ছে।
এ পরিস্থিতির বর্ণনায় রেমন্ড বলেন, ‘স্বৈরশাসকদের অধীন মিয়ানমারে বাস করা জাহান্নামে বাস করারই নামান্তর।’ রেমন্ডের সঙ্গে বিক্ষোভ করেন মিনউইন ও। তিনিও সেনাবাহিনীর হাত থেকে প্রাণে বেঁচে ফেরার কথা জানালেন। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে কয়েকবার বন্দুকযুদ্ধের মধ্যে পড়লেও প্রাণ নিয়ে ফিরতে পেরেছেন।
দাউই শহরে সরকারি কর্মচারীরা প্রথম যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেসব বিক্ষোভের একটির আয়োজক ছিলেন মিয়ানমারের সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও প্রকৌশলী মিনউইন। তিনি যেখানে আত্মগোপনে ছিলেন, সেখানে গত মার্চে সেনারা অভিযান চালায় এবং আটজনকে গ্রেপ্তার করে। এপ্রিলের মধ্যেই তিনি সেখান থেকে সরে লংগোলনে আত্মগোপনে চলে যান। সেখানে গিয়ে আবারও বিক্ষোভকারীদের সংঘবদ্ধ করেন। সেখানে তাঁর নেতৃত্ব আবার বিক্ষোভ শুরু হয়।
অনুবাদ করেছেন আল–আমিন সজীব