ইনুকাই সুইয়োশি ও চার্লি চ্যাপলিন
ইনুকাই সুইয়োশি ও চার্লি চ্যাপলিন

ফিরে দেখা

জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চার্লি চ্যাপলিনকেও হত্যা করতে চেয়েছিলেন খুনিরা

১৯৩০-এর দশকের সূচনালগ্ন জাপানের জন্য ছিল এক অস্থির সময়। সামরিক শক্তির দিক থেকে জাপান ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছিল। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ওপর অধিক নিয়ন্ত্রণ চাইছিল সেনা ও নৌবাহিনী। তারা দেশের বাইরে উপনিবেশ গড়তে মরিয়া ছিল।

তবে সামরিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে নেতৃত্বের উগ্র জাতীয়তাবাদী অংশের সামনে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হয়ে দেখা দিয়েছিল জাপানের বেসামরিক প্রশাসন। তারা এক দশকের বেশি সময় ধরে ধীরে হলেও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার একটি ধারা গড়তে সক্ষম হয়েছিল।

ফলে বেসামরিক নেতৃত্বকে ক্ষমতাচ্যুত করে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছিল সামরিক বাহিনীর একটি অংশ। এর অগ্রভাগে ছিলেন উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ নৌবাহিনীর একদল তরুণ কর্মকর্তা।

এমন এক টালমাটাল সময়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইনুকাই সুইয়োশি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় একদল উগ্র জাতীয়তাবাদী নৌ কর্মকর্তার হাতে নির্মমভাবে নিহত হন তিনি।

ইনুকাই হত্যার মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর্যন্ত জাপানের সরকারি সিদ্ধান্তে বেসামরিক রাজনৈতিক প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের ইতি ঘটে।

সাংবাদিক থেকে রাজনীতিক

ইনুকাইয়ের জন্ম ১৮৫৫ সালে। জাপানের ওকাইয়ামার একটি সামুরাই পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৮৭৬ সালে তিনি টোকিওতে চলে যান। মর্যাদাসম্পন্ন কেইও গিজুকু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক করেন। তিনি চীনা অধ্যয়নে বিশেষত্ব অর্জন করেছিলেন।

ইনুকাই সাংবাদিক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। তিনি একাধিক পত্রিকায় কাজ করেন। এমনকি তিনি প্রতিবেদক হিসেবে ১৮৭৭ সালের জাপানের সাতসুমা বিদ্রোহের খবর সংগ্রহ করতে ইম্পিরিয়াল জাপানিজ আর্মির সঙ্গে রণক্ষেত্রে গিয়েছিলেন।

একপর্যায়ে সাংবাদিকতার ইতি টানেন ইনুকাই। নাম লেখান রাজনীতিতে।

মূলত একটি রাজনৈতিক দল গঠনে ইনুকাইয়ের সহায়তা চেয়েছিলেন জাপানি রাজনীতিবিদ ওকুমা শিগেনোবু। তাঁর ডাকে সাড়া দেন ইনুকাই। তিনিসহ অন্যদের প্রত্যক্ষ সহায়তায় ১৮৮২ সালে কনস্টিটিউশনাল রিফর্ম পার্টি গঠন করেন ওকুমা। একজন উদারপন্থী হিসেবে ইনুকাই এই দলের রাজনীতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন।

ইনুকাই প্রথমবার ইম্পিরিয়াল ডায়েটের ওকাইয়ামা আসনে ১৮৯০ সালে জয়ী হন। তিনি আমৃত্যু এই আসনের সদস্য ছিলেন। ৪২ বছরে (১৮৯০-১৯৩২) তিনি মোট ১৭ বার ডায়েট সদস্য নির্বাচিত হন।

১৮৯৮ সালে প্রধানমন্ত্রী ওকুমার প্রথম সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন ইনুকাই। ১৯১০ সালে তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। নাম কনস্টিটিউশনাল ন্যাশনালিস্ট পার্টি।

সাবেক সেনা জেনারেল কাৎসুরা তারোর সরকারের বিরুদ্ধে ১৯১৩ সালে একটি জনপ্রিয় আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ইনুকাই। তাঁর প্রচেষ্টায় কাৎসুরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন।

১৯২২ সালে ইনুকাই আরেকটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। নাম রিফর্ম ক্লাব। পরের বছর ১৯২৩ সালে তিনি আবার মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। এবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ইয়ামামোতো গোননোহিয়ের দ্বিতীয় দফার সরকারের যোগাযোগমন্ত্রী হন।

ইনুকাই ১৯২৪ সালে এই সরকার ছাড়েন। তিনি ফ্রেন্ডস অব কনস্টিটিউশনাল গভর্নমেন্ট পার্টিতে যোগ দেন। পরে কাতো তাকাকির সরকারের (১৯২৪-২৬) যোগাযোগমন্ত্রী হন। ১৯২৯ সালে তিনি ফ্রেন্ডস অব কনস্টিটিউশনাল গভর্নমেন্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট হন।

যে পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী

১৯৩১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ইম্পিরিয়াল জাপানিজ আর্মি চীনের মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। পরবর্তী সময়ে সেখানে মাঞ্চুকুয়ো নামে জাপানি পুতুল সরকার গঠন করা হয়।

মাঞ্চুরিয়া আক্রমণের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ওয়াকাতসুকি রেইজিরো। তিনি ইম্পিরিয়াল জাপানিজ আর্মি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি মাঞ্চুরিয়ার ঘটনা ঠেকাতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে চীনের সঙ্গে আরও বৈরিতা সৃষ্টি থেকে সেনাবাহিনীকে বিরত রাখতে পারছিলেন না তিনি। তা ছাড়া অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রেও তিনি ব্যর্থ হন। এসব ব্যর্থতার জেরে ১৯৩১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গেনরো নামে পরিচিত জাপানের তৎকালীন প্রবীণ রাষ্ট্রনায়কদের একজন সাইয়োনজি কিমমোচি দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদে ইনুকাইয়ের নাম সুপারিশ করেন। তাঁর প্রত্যাশা ছিল, চীনা জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে থাকা দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত সংযোগ কাজে লাগিয়ে ইনুকাই একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজে পাবেন।

৭৬ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাপানের ২৯তম প্রধানমন্ত্রী হন ইনুকাই। তিনি জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে দ্বিতীয় বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর বিবিধ অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন ইনুকাই। তবে তা শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি।

ইনুকাই সামরিক বাহিনীর লাগাম টানার চেষ্টা করেন। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপচেষ্টার কঠোর বিরোধিতা করেন তিনি। চীনের সঙ্গে আলোচনার জন্য একজন প্রতিনিধি পাঠানোর প্রস্তুতি নেন। একই সঙ্গে চীনে সেনা মোতায়েন সীমিত রাখতে চেয়েছিলেন তিনি। ইনুকাইয়ের এসব কর্মকাণ্ড সামরিক বাহিনীতে থাকা উগ্র জাতীয়তাবাদীদের ক্ষুব্ধ করে তোলে।

বাসভবনে নিহত প্রধানমন্ত্রী

১৯৩২ সালের ১৫ মে। এদিন জাপানে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়। ইম্পিরিয়াল জাপানিজ নৌবাহিনীর প্রতিক্রিয়াশীল অংশ এই অভ্যুত্থানচেষ্টা শুরু করে। এতে সহায়তা করে ইম্পিরিয়াল জাপানিজ আর্মির ক্যাডেট ও অতি জাতীয়তাবাদী বেসামরিক গোষ্ঠীর লোকজন।

সেদিন টোকিওতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছাড়াও আরও কয়েকটি জায়গায় হামলা হয়। ইনুকাই প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ছিলেন। সেখানে ১১ জন কনিষ্ঠ নৌ কর্মকর্তা হামলা চালান। হামলাকারীদের মধ্যে এই ভাবনা কাজ করছিল যে প্রধানমন্ত্রী ইনুকাই সামরিকবাদে যথেষ্ট বিশ্বাসী নন। তিনি নৌবাহিনীকে যথেষ্ট অর্থায়ন করছেন না। তাই তাঁকে সরিয়ে দিতে হবে।

ঘাতকদের উদ্দেশে ইনুকাইয়ের শেষ কথাগুলো ছিল এমন: ‘আমরা যদি আলোচনা করতে পারতাম, তাহলে তোমরা বুঝতে পারতে।’ জবাবে খুনিদের নেতা চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘আলোচনা অর্থহীন।’ তারপরই ইনুকাইকে গুলি করে হত্যা করা হয়।

ইনুকাই হত্যার বিচার

ইনুকাইকে হত্যা করা হলেও শেষ পর্যন্ত আর অভ্যুত্থান হয়নি। পরে হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ইনুকাইকে হত্যার ঘটনায় ১১ নৌ কর্মকর্তাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।

আদালতে বিচার চলাকালে ঘাতকদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানা যায়। ঘাতকদের ভাষ্যমতে, তাঁদের মূল পরিকল্পনায় হলিউড তারকা চার্লি চ্যাপলিনকে হত্যার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যদিও চ্যাপলিন ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক, তবু চক্রান্তকারীরা ভেবেছিলেন, তাঁর মতো বিশ্ববিখ্যাত অভিনেতাকে হত্যা করলে জাপানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র চরমভাবে ক্ষুব্ধ হবে। এর জেরে যুদ্ধ বাধবে।

ইনুকাই হত্যার আগের দিনই জাপানে এসেছিলেন চ্যাপলিন। তিনি ছিলেন ইনুকাইয়ের অতিথি। কিন্তু ঘাতকেরা যখন প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন হামলা চালান, তখন তিনি বাইরে ছিলেন। ফলে তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

বিচার চলাকালে হত্যাকারীরা জাপানের সাধারণ জনগণের ব্যাপক সহানুভূতি অর্জন করেন। আদালতে এক লাখের বেশি পিটিশন আসে। যেগুলোর কিছু ছিল রক্তে লেখা। এসব আবেদনে হত্যাকারীদের লঘু সাজা দেওয়ার আরজি ছিল। বিচারে ইনুকাইয়ের খুনিদের লঘু সাজা হয়। কয়েক বছর পর তাঁরা কারাগার থেকে মুক্তি পান। এই বিচার জাপানে বাজে নজির হয়ে থাকে। জাপানের সামরিকবাদকে আরও শক্তিশালী করে। গণতন্ত্র ও আইনের শাসনকে করে দুর্বল।

তথ্যসূত্র: ব্রিটানিকা, এনসাইক্লোপিডিয়া, ওয়ার হিস্টোরি অনলাইন, জাপান টুডে, ন্যাশনাল ডায়েট লাইব্রেরি (জাপান)।