আফগানিস্তানের ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে
আফগানিস্তানের ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে

আফগানিস্তানে তীব্র অপুষ্টি

মায়েদের চোখের সামনেই মারা যাচ্ছে অনাহারী শিশুরা

‘আমার জন্য এ যেন এক কিয়ামত। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমার শিশুসন্তানদের চোখের সামনে মারা যেতে দেখেছি। আমি কোন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছি, তা কি আপনি কল্পনা করতে পারেন?’ কথাগুলো বলছিলেন আফগানিস্তানের আমিনা নামের এক নারী।

আমিনা এরই মধ্যে তাঁর ছয় শিশুসন্তানকে হারিয়েছেন। তাদের সবার বয়স তিন বছরের কম ছিল। আরেক কন্যাসন্তান বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করছে। সাত মাস বয়সী ওই শিশুর নাম বিবি হাজেরা। এই বয়সেও তাকে দেখে নবজাতক মনে হয়। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুটি পূর্ব আফগানিস্তানের নানগারহার প্রদেশের জালালাবাদ আঞ্চলিক হাসপাতালে ভর্তি।

নিজের সন্তানদের এই দুর্দশার কারণে চরম ক্ষোভ রয়েছে আমিনার মনে। প্রায় চিৎকার করতে করতে তিনি বলছিলেন, ‘দারিদ্র্যের কারণে আমার শিশুসন্তানেরা মারা যাচ্ছে। তাদের আমি শুকনো রুটি আর সূর্যের তাপে গরম করা পানি ছাড়া কিছু খাওয়াতে পারি না।’

আফগানিস্তানে ৩২ লাখ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। বিবি হাজেরা তাদেরই একজন। দেশটিতে ৪০ বছর ধরে চলা যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের কারণেই দেখা দিয়েছে অপুষ্টির এই সমস্যা। বর্তমানে সমস্যাটি নজিরবিহীন অবস্থায় পৌঁছেছে। জালালাবাদ আঞ্চলিক হাসপাতালের একটি কক্ষ থেকে এই বিপর্যয় সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।

হাসপাতালের ওই কক্ষে সাতটি শয্যায় ১৮টি শিশু রয়েছে। এমন নয় যে বিশেষ কোনো সময়ে সেখানে রোগীর সংখ্যা বাড়ে। বরং হাসপাতালটিতে দিনের পর দিন এই অবস্থাই চলছে। কক্ষটিতে কোনো কান্নাকাটি বা কোলাহল নেই। শোনা যায় কেবল শিশুদের হৃৎস্পন্দন মাপার যন্ত্রের ‘টিক টিক’ শব্দ। নীরবতার কারণ এই নয় যে শিশুরা ঘুমাচ্ছে বা অক্সিজেন মাস্ক পরে আছে। অধিকাংশ শিশুই জাগ্রত। তবে নড়াচড়া বা শব্দ করার মতো শক্তি তাদের শরীরে নেই।

বিবি হাজেরার সঙ্গে হাসপাতালের একই শয্যায় রয়েছে তিন বছর বয়সী সানা। কয়েক মাস আগে আরেক সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে তার মা মারা যান। হাসপাতালে সানার দেখভাল করছেন তার খালা লাইলা। তিনি তাঁর দুই হাতের সাতটি আঙুল উঁচিয়ে ধরলেন। বোঝাতে চাইছিলেন, তাঁর সাতটি শিশুসন্তান মারা গেছে।

হাজেরা ও সানার শয্যার পাশের শয্যায় রয়েছে তিন বছর বয়সী ইলহাম। অপুষ্টির কারণে বয়সের চেয়ে অনেক ছোট দেখায় তাকে। ইলহামের হাত, পা ও মুখ থেকে চামড়া উঠে যাচ্ছে। তার দুই বছর বয়সী এক বোনও অপুষ্টির শিকার হয়ে মারা যায়। সে ঘটনা তিন বছর আগের।

পাশের শয্যায় এক বছর বয়সী আসমার দিকে তাকানো আরও কষ্টের। তার চোখ সুন্দর—বাদামি রঙের। পাপড়িগুলো লম্বা। চোখ দুটি বড় করে তাকিয়ে ছিল সে। ছোট্ট মুখমণ্ডলের অধিকাংশ অক্সিজেন মাস্কে ঢাকা। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছিল। আসমার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা চিকিৎসক সিকান্দার গনি মাথা নেড়ে বলেন, ‘আমার মনে হয় না সে বাঁচবে।’

হাসপাতালের কক্ষে আসমার মা নাসিবা কাঁদছিলেন। নিকাব সরিয়ে মেয়েকে চুমু খেতে সামনের দিকে কিছুটা ঝোঁকেন তিনি। বলেন, ‘মনে হচ্ছে আমার শরীর থেকে মাংস গলে যাচ্ছে। তার (আসমা) এভাবে কষ্ট পাওয়াটা আমি সহ্য করতে পারছি না।’ তিন সন্তান হারানো নাসিবা জানান, তাঁর স্বামী দিনমজুর। তিনি কাজ পেলেই পরিবারের সদস্যদের খাওয়া হয়। চিকিৎসক সিকান্দার গনি বলছিলেন, যেকোনো মুহূর্তে আসমার হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। এরপর এক ঘণ্টাও সে বাঁচেনি।

নানগারহার প্রদেশে তালেবানের স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, আফগানিস্তানের হাসপাতালটিতে গত ছয় মাসে ৭০০ শিশু মারা গেছে। অর্থাৎ দিনে তিনটির বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের তহবিল না পেলে দেশটিতে শিশুমৃত্যু আরও বাড়ত।

২০২১ সালের আগস্ট তথা তালেবান কাবুল নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগপর্যন্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা সরাসরি আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যেত। তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর সরাসরি সহায়তা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, তালেবানের ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে দেশটির স্বাস্থ্য খাত ভেঙে পড়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো কিছু কিছু সহায়তা দিচ্ছে।

দাতা সংস্থাগুলো যে অল্প অল্প সহায়তা দিচ্ছে, তা আফগানিস্তানের সমস্যা সমাধানের জন্য যথেষ্ট নয়। একদিকে বিশ্বের মনোযোগ অন্যদিকে সরে যাওয়ায় আফগানিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা আরও কমে এসেছে। অন্যদিকে নারীদের বিষয়ে নানা কড়াকড়িসহ তালেবান সরকারের বিভিন্ন নীতির কারণে দাতারা তহবিল দিতে দ্বিধা করছে।

তালেবান সরকারের মুখপাত্র হামদুল্লাহ ফিতরাত বলেন, ‘দারিদ্র্য ও অপুষ্টির সমস্যা আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি। বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে এই সমস্যা আরও বেড়েছে। (তাই আফগানিস্তানে) আন্তর্জাতিক মহলের মানবিক সহায়তা বাড়ানো উচিত। তাঁদের এটাকে রাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করা ঠিক হবে না।’

চিকিৎসক সিকান্দার গনি বলেন, ‘আমরা যদি আরও বেশি ওষুধ, সুযোগ-সুবিধা ও কর্মী পাই, তাহলে বেশিসংখ্যক শিশুর জীবন বাঁচানো যাবে। আমাদের কর্মীরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা নিরলসভাবে কাজ করছি। আরও বেশি কাজ করতে প্রস্তুত। আমারও শিশুসন্তান রয়েছে। যখন একটি শিশু মারা যায়, তখন আমরাও কষ্ট পাই। (একটি শিশু মারা গেলে) মা-বাবার হৃদয়ে কী হয়, তা আমি জানি।’