২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসে তালেবান। এর পর থেকে দেশটিতে কয়েক শ আফগানকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলছে, আগের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছিল তালেবান। এরপরও দেশটির অনেক মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
গতকাল মঙ্গলবার আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশন (ইউএনএএমএ) এ–সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, তালেবানের ক্ষমতা নেওয়ার পর আফগানিস্তানে ৮০০টির বেশি গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, জোরপূর্বক গুমসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের খবর জাতিসংঘের নজরে এসেছে। এর মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অন্তত ২১৮টি ঘটনা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আফগান সেনাবাহিনী, পুলিশ ও জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যবস্তু বানানো হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান রাষ্ট্রক্ষমতা নেওয়ার পরবর্তী কয়েক মাসে এসব ঘটনা বেশি ঘটেছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেন, ‘ক্ষমতা গ্রহণের পর আগের সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীতে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের সঙ্গে তালেবান যেসব মর্মান্তিক আচরণ করেছে, এই প্রতিবেদন সেই চিত্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছে। অথচ এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না বলে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। এটা জনগণের আস্থার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।’
পশ্চিমা সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসে তালেবান। এই গোষ্ঠীর উগ্রপন্থী মনোভাব, বিশেষ করে এর আগের তালেবান শাসনামলের অভিজ্ঞতা মনে রেখে অনেকেই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগে ভুগেছেন। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে তালেবান নিজেদের ভাবমূর্তি ফেরাতে সচেষ্ট ছিল। অনেকটাই মধ্যপন্থী মনোভাব দেখিয়েছিল। এ জন্য ক্ষমতায় আসার পর আগের সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার জন্য ‘সাধারণ ক্ষমা’ ঘোষণা করেছিল তালেবান।
তবে এ অবস্থানে বেশি দিন থাকেনি তালেবান। এরপর গ্রেপ্তার, আটক, নির্যাতন, দুর্ব্যবহার, জোরপূর্বক গুমসহ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া নারীদের প্রতি কঠোর অবস্থান নিয়েছে তালেবান। নারীদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ভ্রমণ ও ব্যায়ামাগার, বিনোদন কেন্দ্রে যাওয়া এবং এনজিওতে কাজ করায় নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে নারীদের রূপচর্চাকেন্দ্র। নিষিদ্ধ করা হয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রম।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো শুরু থেকেই তালেবানের এমন অবস্থানের কঠোর নিন্দা জানিয়ে আসছে। এসব সংস্থা তালেবানের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ তুলেছে।
আফগানিস্তানের আগের সরকার ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের ওপর ১১৪টি নির্যাতন ও দুর্ব্যবহারের ঘটনা প্রতিবেদনে নথিবদ্ধ করেছে ইউএনএএমএ। এ ছাড়া নথিবদ্ধ করা হয়েছে ৪২৪টির বেশি নির্বিচার গ্রেপ্তার ও আটক এবং অন্তত ১৪টি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা। এর মধ্যে হেরাতের নারী কারাগারের প্রধান আলিয়া আজিজির গুমের ঘটনা রয়েছে। ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে তাঁকে আর দেখা যায়নি।
প্রতিবেদনের জন্য যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে, তাঁরা তালেবানের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের কাছ থেকে হুমকি পেয়েছেন, গালিগালাজ শুনেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অনেকে তাঁদের আত্মীয়স্বজনের গুম হওয়ার ঘটনা বলেছেন। অনেকে বলেছেন, নিখোঁজের কয়েক মাস পর কারও কারও মরদেহ পাওয়া গেছে।
তালেবানের এমন অত্যাচার–নির্যাতন ও দমনমূলক নীতির প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন অনেকে। বিশেষ করে নারীরা প্ল্যাকার্ড হাতে রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। নারীদের অভিযোগ, তালেবানের দুই বছরে আফগান নারীদের সবকিছু থেকে মুছে ফেলা হচ্ছে।
তবে তালেবান বলছে, তারা দেশকে বিদেশি দখলদারমুক্ত করেছে। এর আগে তালেবানের উপমুখপাত্র বিলাল করিমি সিএনএনকে বলেছিলেন, ‘আফগানরা তাঁদের দেশ, স্বাধীনতা, সরকার এবং নিজেদের ইচ্ছা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন।’
এ পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহায়তা মিশনের প্রধান রোজা ওতুনবায়েভা তালেবানের প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তালেবান সাধারণ ক্ষমার কথা বলেছিল। প্রতিশ্রুতি পূরণ করা প্রয়োজন। দেশে ন্যায়বিচার, পুনর্মিলন ও শান্তির সম্ভাবনা নিশ্চিত করার জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।