এশিয়ায় উড়োজাহাজের টিকিটের দাম বেশি কেন

  • ২০১৯ সালের তুলনায় টিকিটের দাম ৩৩ শতাংশ বেশি

  • যাত্রীদের চাহিদার তুলনায় এয়ারলাইনসগুলোর সক্ষমতা কম

  • জ্বালানির দাম বেশি, রুশ আকাশসীমা বন্ধ থাকায় যাত্রাপথের দূরত্বও বেশি

করোনা মহামারির পর যাত্রীদের চাহিদার তুলনায় সক্ষমতা বাড়াতে পারেনি এয়ারলাইনস সংস্থাগুলো

করোনা মহামারি অনেকটা স্তিমিত। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে মানুষ। আকাশে ফিরেছে উড়োজাহাজ। শুরুতে প্রচুর ভিড় থাকলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসছে। কিন্তু এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এখনো উড়োজাহাজের টিকিটের দাম অনেক বেশি।

স্কাইস্ক্যানার ট্রাভেল ইনসাইটের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনায় গত ফেব্রুয়ারিতে এই অঞ্চলে টিকিটের দাম ৩৩ শতাংশ বেশি ছিল। অথচ একই সময়ে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় যথাক্রমে টিকিটের দাম বেড়েছে ১২ ও ১৭ শতাংশ।

কিছু কিছু ক্ষেত্রে চার বছর আগের তুলনায় এখন যাত্রীদের বিমানের ভাড়া দ্বিগুণ গুনতে হচ্ছে।  

আমেরিকান গ্লোবাল বিজনেস ট্রাভেলের (অ্যামেক্স জিবিটি) হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে প্যারিস থেকে সাংহাইয়ে বিজনেস শ্রেণির টিকিটের দাম ছিল ৫ হাজার ৬৫০ মার্কিন ডলার (১০৭ টাকা ডলার হিসাবে ৬ লাখ ৪ হাজার ৫৫০ টাকা)। এখন সেই টিকিটের দাম দ্বিগুণ ১১ হাজার ৫০০ ডলার (১২ লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা)।
অ্যামেক্স জিবিটি বলছে, সিঙ্গাপুর থেকে সাংহাই যাওয়ার বিমান টিকিটের দামও ২০১৯ সালের তুলনায় এখন দ্বিগুণ।

স্কাইস্ক্যানারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিউ এইটকেন বলছেন, নানা কারণে এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে টিকিটের দাম বাড়তে পারে। নানা কারণে কোভিডের আগের তুলনায় সারা বিশ্বে উড়োজাহাজের টিকিটের দামও বেড়েছে।

তবে হিউ এইটকেন বলছিলেন, অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যাত্রীদের বিমানের ভাড়া নিয়ে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কিছুটা অপ্রত্যাশিত বটে। আবার এই সমস্যা খুব দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে, এমনটাও মনে হচ্ছে না।

অ্যামেক্স জিবিটির পূর্বাভাস বলছে, উড়োজাহাজের ইকোনমি শ্রেণিতে গত বছরের তুলনায় এবার উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে টিকিটের দাম যথাক্রমে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ ও ৯ দশমিক ৮ শতাংশ বাড়তে পারে। ইউরোপ থেকে পৃথিবীর অন্যান্য গন্তব্যে টিকিটের দাম দ্বিগুণও হয়ে যেতে পারে। বিজনেস শ্রেণির ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হতে পারে।

ভাড়া বৃদ্ধির কারণ কী

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব কিছুর মূল্যবৃদ্ধি, শ্রমিক–সংকট এবং রাশিয়ার আকাশসীমা বন্ধের কারণে উড়োজাহাজ ভাড়া বাড়ছে।

এশিয়া অঞ্চলের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় বিষয় রয়েছে। করোনার পর এই অঞ্চলে মাত্র সবকিছু স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপে সীমান্ত বিধিনিষেধ অনেক আগেই তুলে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার দেশগুলো মাত্র ২০২২ সালে পর্যটকদের জন্য উম্মুক্ত করতে শুরু করেছে।

চীনের মূল ভূখণ্ড তিন বছর পর গত জানুয়ারিতে কেবল আন্তর্জাতিক পর্যটকদের জন্য কোয়ারেন্টিনের বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে। গত সপ্তাহে পর্যটকসহ সব ধরনের মানুষকে চীনের ভিসা দেওয়া শুরু করেছে।

এইটকেন বলেন, যেখানে মাত্র বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে, বিমান চলাচল পুরোদমে চালু হয়েছে, সেখানে যাত্রীর চাপ থাকবে—সেটিই স্বাভাবিক। আর তাতেই বেড়েছে উড়োজাহাজের টিকিটের দাম। এখন এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এটাই ঘটছে।

অ্যামেক্স জিবিটির জেরেমি কুয়েক বলেন, চাহিদা বেড়ে গেলে তাৎক্ষণিক অতিরিক্ত সেবার জোগান দেওয়া কোনো এয়ারলাইনসের পক্ষে সহজ নয়। সেবা বাড়াতে হলে ক্রু, গ্রাউন্ড স্টাফ, বিমানবন্দর ব্যবস্থাপনা, বিমানবহরে অতিরিক্তি বিমান যুক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয় রয়েছে।

সিঙ্গাপুরের চাঙ্গি বিমানবন্দর হয়ে যাত্রীরা গন্তব্যে যাচ্ছেন

জেরেমি কুয়েক বলেন, সুতরাং একটি উড়োজাহাজের জন্য আলাদা সময়সূচি বের করে নিতে কয়েক মাস লেগে যায়। বর্তমানে বিভিন্ন উড়োজাহাজ সংস্থার ফ্লাইট সংখ্যাই সেই বিষয়টি বলে দিচ্ছে।

ট্রিপ ডট কমের প্রধান নির্বাহী জেন সান বলেন, চীনের সবকিছু চালুর পরও কোভিডের আগের তুলনায় বিদেশমুখী ‘বতর্মান ফ্লাইটের সক্ষমতা ১৫ থেকে ২০ শতাংশ।’
জেন সান বলেন, চলতি মাসের চাহিদা বিবেচনা করলে দেখা যায়, সবকিছু খুলে দেওয়া হলেও চীন থেকে বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা ভ্রমণের স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করছে।

অ্যামেক্স জিবিটির তথ্যমতে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট সক্ষমতা, বিশেষ করে ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে সক্ষমতার হার ২০১৯ সালের তুলনায় মাত্র ১৭ শতাংশ।

কুয়েক বলেন, উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর সক্ষমতা বাড়বে। তবে আমরা যে গতিতে আশা করছি, সেভাবে সম্ভব নয়। এ কারণেই পরিস্থিতি এখনো জটিল। তিনি বলেন, কম সক্ষমতা এবং ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে টিকিটের দাম বেশি।

ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর রাশিয়া অনেক দেশের এয়ারলাইনসের জন্য তাদের আকাশসীমা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে অনেক উড়োজাহাজ সংস্থাকে নতুন করে বিমান রুট ঠিক করতে হয়েছে। এতে পথের দূরত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি খরচও বেড়েছে। এখনো বিধিনিষেধ আছে। এতে এশিয়ার সঙ্গে উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের রুটে বিমান ভাড়ায় প্রভাব ফেলছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উড়োজাহাজকে টোকিও থেকে লন্ডনে এখন উত্তর প্রশান্ত মহাসাগর, আলাস্কা, কানাডা ও গ্রিনল্যান্ড হয়ে যেতে হয়। এতে অতিরিক্ত ২ ঘণ্টা ৪০ মিনিট লাগে। যাতে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ জ্বালানি খরচ হয়, যার পরিমাণ ৫ হাজার ৬০০ গ্যালন।

অস্ট্রেলিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থা কানতাসের প্রধান নির্বাহী অ্যালান জয়েস বলেন, এমনিতে জ্বালানির দাম বেশি। ফলে অতিরিক্ত মূল্য এবং পথের দূরত্বের কারণে ২০১৯ সালের তুলনায় তাদের জ্বালানি ব্যয় ৬৫ শতাংশ বেড়েছে।

অ্যালান বলেন, কোভিডের আগের তুলনায় উড়োজাহাজ ভাড়া বাড়াতেই হবে। কারণ, জ্বালানির দাম এবং অতিরিক্ত জ্বালানি—দুটি বিষয় আছে। তিনি বলেন, বিমান সংস্থা করোনা মহামারির সময় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এখন আবার ক্রুদের নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হচ্ছে। কারণ, মহামারির সময় তারা দীর্ঘদিন পেশার বাইরে ছিলেন।

গ্রাহকদের ওপর প্রভাব

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিছু কিছু ভ্রমণকারীর জন্য এই ভাড়া হতাশার হলেও বেশির ভাগ পর্যটককে এই অতিরিক্ত ভাড়াও দমিয়ে রাখতে পারবে না। আবার এটাও ঠিক, এমন পর্যটক না থাকলে এই খাতকে পুরোপুরি সচল করাও কঠিন হয়ে পড়বে।

এইটকেন বলেন, ‘বিমানভাড়া বৃদ্ধির পরও আমরা বর্তমানে যাত্রীদের আস্থায় ঘাটতি দেখছি না। ২০২৩ সালের শুরু থেকেও আমরা যাত্রীদের ব্যাপক চাপ দেখছি।’
সান বলেন, চীন থেকে বিদেশগামী পর্যটকদের চাপ বছরে দ্বিতীয় কোয়ার্টারে আরও বাড়বে। উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোও ধীরে ধীরে সেবার মান স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে পারবে।

কিছু কিছু এয়ারলাইনস কৌশল হিসেবে অতিরিক্ত ভাড়া হাঁকিয়ে যাত্রী টানতে আবার মূল্যছাড় দিচ্ছে।

কানতাস ও জেটস্টার বলছে, চলতি বছর তারা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে প্রায় ১০ লাখ আসনে মূল্যছাড়ের ঘোষণা দিয়েছে।

জাপান এয়ারলাইনস যাত্রীদের জন্য টিকিটের দাম কমানোর চেষ্টা করছে। অবশ্য, ধারণার চেয়ে তাদের টিকিটের চাহিদা অনেক বেশি হওয়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। চলতি মাসের শুরুর দিকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে তারা মূল্যছাড়ের প্রচার শুরু করলে তাদের ওয়েবসাইট অচল হয়ে পড়ে।

সংস্থাটি এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ‘আমাদের সাইটে এত বেশি ভিজিটর এসেছিলেন যে আমাদের ব্যবস্থা সেটা সামাল দিতে পারেনি।’

এইটকেন বলেন, সব বিমান রুটে টিকিটের দাম বাড়েনি। এখনো গ্রাহকেরা প্রতিযোগিতামূলক দামে টিকিট কিনতে পারছেন। বিশেষ করে তাঁরা কখন, কোথায় যাচ্ছেন—সে বিষয়ে নমনীয় থাকলে কম দামে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।

এইটকেন আরও বলেন, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চলতি বছরের শেষে যুক্তরাজ্য থেকে ভিয়েতনাম বা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মালয়েশিয়া ভ্রমণের টিকিট খরচ গত বছরের তুলনায় কম পড়বে।

স্কাইস্ক্যানারের ভাইস প্রেসিডেন্ট হিউ এইটকেন বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পর্যটকদের জন্য ভালো হবে পরিকল্পনা করে আগেভাগে টিকিটের বুকিং দেওয়া।