মালদ্বীপে ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচত হয়েছেন চীনপন্থী মোহামেদ মুইজ্জু। প্রভাবশালী দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক কৌশলের জায়গায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে দেশটি। কে জিতলেন, কে হারলেন—তার চেয়ে বড় কথা ভারত ও চীন দেশটি নিয়ে কী ভাবছে। ফলে নতুন এক ‘মহাসমরে’ পড়ে যাচ্ছে দ্বীপদেশটি।
বাংলাদেশে কীভাবে ভোট হবে, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কায় আদৌ ঠিক সময়ে ভোট হবে কি না—এসব নিয়ে আন্তর্জাতিক সমাজে জল্পনার শেষ নেই। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের ভোট নিয়ে বহির্বিশ্বে বেশি কথার এ এক নতুন সাম্প্রতিক বৈশিষ্ট্য। মালদ্বীপের ভোট নিয়েও তুমুল আগ্রহ ছিল ওয়াশিংটন, বেইজিং, নয়াদিল্লি ছাড়িয়ে মস্কো পর্যন্ত। পাঠক এর মধ্যে সেই ভোটের ফল জেনে গেছেন। কিন্তু আলাপ তাতে থামেনি। অনেকের প্রশ্ন, এই ভোট কি তবে মালদ্বীপকে ভূরাজনীতির এক বৃত্ত থেকে আরেক বৃত্তে টেনে নিল?
এ বছরের ২৮ জুলাই প্রথম আলো মালদ্বীপের নির্বাচনকে ‘মহাসমর’ বলে উল্লেখ করেছিল। এখন বলতে হচ্ছে ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া নির্বাচনের ভেতর দিয়ে ওই সমর থামছে না, আরেক দফা শুরু হলো কেবল।
অনেকে জানেন, সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহামেদ মুইজ্জু বা পরাজিত প্রার্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ মালদ্বীপের প্রধান রাজনীতিবিদ নন। নানান রাজনৈতিক দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে এই দুজন সামনে চলে এসেছেন। যেকোনো রক্তাক্ত যুদ্ধই নতুন তারকা তৈরি করে। মালদ্বীপে এই দুজনের মধ্যে ভোটের মীমাংসায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো শান্ত অধ্যায়ের সূচনা হচ্ছে না।
দেশটির প্রধান দুই রাজনীতিবিদের একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন এখন বন্দী। আর মোহাম্মদ নাশিদ নতুন দল গড়ে নতুন করে রাজনীতির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইয়ামিনের লক্ষ্য এখন কারাগার থেকে বের হওয়া। নাশিদের লক্ষ্য প্রধান বিরোধী নেতা হয়ে ওঠা এবং ভবিষ্যতের যেকোনো পরিবর্তনে নিজের দাবি পেশ। ফলে ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে মালদ্বীপে রাজনীতির নতুন এক কালপর্বের পর্দা উঠল শুধু।
পাশাপাশি এ–ও সত্য, ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় মালদ্বীপে নতুন একটা ‘মহাসমর’ শুরু হচ্ছে। চীনপন্থী হয়ে আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে যদি কারাগারে থাকতে হয় এবং ভারতের প্রতি পক্ষপাতের কারণে যদি সলিহ কম ভোট পান, তাহলে অধ্যায়টি এখানেই শেষ হচ্ছে না। মালদ্বীপে চীন ও ভারতের অনেক ‘বিনিয়োগ’ ঘটে গেছে ইতিমধ্যে। তার চেয়েও বড় বিষয় বৈশ্বিক ঠান্ডা যুদ্ধের সময় সাগরের মাঝখানে থাকা মালদ্বীপকে দরকার চীন-ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রেরও।
দেশটির আয়তন যে ৩০০ বর্গকিলোমিটারও নয় এবং সেখানে যে মাত্র পাঁচ লাখ মানুষ আছে, সেটা এখন আর কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়। অতীতে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার জন্য খনিজ বা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়ার শর্ত থাকত। সেসব এখন আর গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে না। বরং ভৌগোলিক অবস্থান ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের জায়গায় চলে আসছে। মালদ্বীপ এই নতুন মানদণ্ডে পড়ে গেছে।
নিজেদের দেশটি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ হয়ে ওঠায় মালদ্বীপের মুসলমানদের তেমন হাত নেই। তেমন কর্তৃত্বও নেই। বার্তা সংস্থা এপি ১ অক্টোবর মালদ্বীপের নির্বাচনী ফলকে বলেছিল ‘চীন-ভারতের গণভোট’। বিষয়টা এমন, যেন মালদ্বীপের ভোটাররা নিজেদের পছন্দের প্রার্থীকে নয়, ভোট দিচ্ছেন চীন বা ভারতকে। তবে দৃশ্যটা করুণ হলেও সত্য, নিজেরা না চাইলেও মালদ্বীপের রাজনীতিবিদেরা ভূরাজনৈতিক বীজগণিতের বাইরে থাকতে পারছেন না। বরং ভূরাজনীতি তাঁদের নিরাপত্তাহীন করে ফেলছে। চীনপন্থী হয়ে সেখানে জেলে যেতে হয়, আর ভারতপন্থী হয়ে ভোটারদের বিরাগে পড়তে হয়। আবার কোনো না কোনো ‘পন্থী’ না হয়ে নিরপেক্ষ হয়ে থাকাও মুশকিল। ফলে মালদ্বীপের ‘যুদ্ধ’টা এক ভোটে শেষ হবার নয়।
এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় এ রকম ‘মালদ্বীপ’ একটাও নয়। মালদ্বীপের ভেতরেও রয়েছে দুটি মালদ্বীপ। একটা মালদ্বীপ পর্যটকদের জন্য সাজানো–গোছানো, সেখানে আছে বহু মনোহর ‘রিসোর্ট দ্বীপ’। সেসব দ্বীপে ‘ভিসা-ফ্রি’ বিদেশিদের জন্য আছে কমবেশি প্রায় ৮ হাজার ‘গেস্টহাউস’।
আছে আন্তর্জাতিক মানের সব ‘সুবিধা’। সেসব সুবিধা দেখলে বোঝা যায়, মালদ্বীপকে কেন ‘প্যারাডাইস’ বলা হয়। আর এর আশপাশে আছে আরেক মালদ্বীপ, যার দ্বীপগুলো জাঁকজমকহীন। পর্যটকদের কাছে সেগুলো ‘লোকাল আইল্যান্ড’। মালে থেকে যে দ্বীপ যত দূরে, সেখানকার বাদামি মানুষগুলোর দারিদ্র্য ও কর্মহীনতার নজিরও তত বেশি। রাজধানী থেকে ৫৪০ মাইল দূরেও দ্বীপ আছে মালদ্বীপে। সেখানকার অধিবাসীদের কাছে প্রতিটা দিনই যুদ্ধময়। তাদের জন্য আছে কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনও। নির্বাচন তাদের জন্য এক দিনের উত্সব। সেই ‘উত্সব’কে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যম ‘ভারত-চীন’ গণভোট আকারে দেখছে। সেই দেখাও পুরো অসত্য নয়।
তবে আসন্ন যুদ্ধটা আবদুল্লাহ ইয়ামিনের জন্যই বেশি তীব্র। নির্বাচনের পরদিনই সেটা শুরু হয়ে গেছে।
সবারই জানা ছিল, সদ্য শেষ হওয়া ভোটে সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের রাজনৈতিক সহযোগীরা যে মোহামেদ মুইজ্জুর বিজয় নিশ্চিত করেছেন, সেটা তাঁদের নেতার মুক্তির জন্য। নির্বাচনী ফল বের হওয়ার ৭২ ঘণ্টার ভেতর তাঁদের চাওয়ার খানিক পূরণও হয়ে গেছে। ইয়ামিন এখন আর কারাগারে নেই। বলা হচ্ছে, তিনি কারাগারের বদলে ঘরে থাকবেন। অর্থাৎ এখন তিনি শুধু ‘গৃহবন্দী’। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত সলিহই ইয়ামিনের দণ্ডাদেশের এ রকম অদলবদল করলেন। বলা বাহুল্য, সেটা হয়তো নিজের ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা ভেবেই।
ইয়ামিনের পর যুদ্ধে নামতে হচ্ছে মোহাম্মদ নাশিদকেও। আপাতত পার্লামেন্টের স্পিকার হলেও তাঁর স্বপ্ন প্রেসিডেন্ট হওয়া। এটা প্রায় নিশ্চিত, সামনের নির্বাচনে যিনিই প্রেসিডেন্ট হতে চাইবেন, তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন নাশিদ। দক্ষিণ এশিয়ায় যাঁরা চীনের প্রভাব নিয়ে উদ্বিগ্ন, তাঁদেরও নাশিদকে মিত্র হিসেবে বিবেচনায় নেওয়ার চাপ থাকবে। কারণ, রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি বেশ প্রভাবশালী।
নির্বাচনে পরাজিত সলিহর জন্য এখনকার যুদ্ধটা হচ্ছে টিকে থাকার। নির্বাচনে হেরে রাজনীতিতে দীর্ঘ সময়ের জন্য পিছিয়ে পড়লেন তিনি। তবে তাঁর জন্য অন্য লড়াই থাকছে। মুইজ্জু প্রেসিডেন্ট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা দায়ের শুরু করতে পারেন। এটাই দক্ষিণ এশিয়ার ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতি’।
মুইজ্জু নির্বাচিত হলেও দায়িত্ব গ্রহণ করতে এখনো বহু দেরি। কিন্তু ইতিমধ্যে তিনি দেশটির চালকের আসনে বসে গেছেন। অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত এবং মালের মেয়র হিসেবে সুনামের অধিকারী মুইজ্জু ইয়ামিনের ছায়ায় বেশি দিন না–ও থাকতে চাইতে পারেন। ফলে তাঁর সঙ্গে ইয়ামিনের একটা ব্যক্তিত্বের সংঘাতও সামনে দেখা যেতে পারে।
আপাতত মালদ্বীপের রাজনীতি এই চারজনকে ঘিরে ঘুরপাক খেলেও দেশটি নিয়ে চীন-ভারত কী ভাবছে, সেটাই রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মনোযোগ পাচ্ছে বেশি।
মুইজ্জুর বিজয়ে সবচেয়ে বেশি আঘাত পেতে দেখা গেল ভারতের প্রচারমাধ্যমকে। হয়তো এটা নয়াদিল্লির অনুভূতিরই প্রকাশ। ভারতের পশ্চিম উপকূল থেকে ৩০০ নটিক্যাল মাইল দূরের (এক নটিক্যাল মাইল=১ দশমিক ১৫ মাইল) দেশ হলেও মহাসাগরের অঞ্চলটি নয়াদিল্লির নৌসেনাদের চলাচলে বিশেষ জরুরি। তা ছাড়া ভারতের নীতিনির্ধারকদের পুরোনো মত, মালদ্বীপ–সংলগ্ন এলাকায় তাঁদের উপস্থিতির বিকল্প নেই। আর মালেতে প্রত্যাশিত নিয়ন্ত্রণ না থাকলে আশপাশের সমুদ্রে প্রভাব খাটানো দুরূহ হয়।
মালেতে প্রভাব ধরে রাখতে চেয়ে ভারত বহুভাবে দ্বীপরাষ্ট্রের শাসকদের অতীতে সাহায্য করেছে। দীর্ঘদিনের একনায়ক মামুন আবদুল গাইয়ুমের বিরুদ্ধে যখন ১৯৮৮ সালে অভ্যুত্থান হচ্ছিল, ভারত ৩০০ নটিক্যাল পথ পেরিয়ে সেটা নস্যাৎ করেছে। আবদুল্লাহ ইয়ামিন সেই মামুন গাইয়ুমেরই সত্ভাই। আর তিনিই মালদ্বীপে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের জন্মদাতা। এই আন্দোলন যত না রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক, তার চেয়ে বেশি ধর্মীয়-লোকরঞ্জনবাদী, প্রচার পেয়েছে তার চেয়েও বেশি। ভারতীয়দের নিয়ে স্থানীয় লোকজনের আস্থাহীনতাও এই আন্দোলনে রসদ জুগিয়েছে।
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন এবারের ভোটযুদ্ধে জনমতের মেরুকরণে ভালোই মদদ দিয়েছে। আবার ইয়ামিনের কারাভোগের পেছনেও এই আন্দোলনের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ছিল। ইয়ামিনের দণ্ড নয়াদিল্লিকে খানিক স্বস্তি দিলেও ৩০ সেপ্টেম্বর মালদ্বীপের সুষ্ঠু ভোট সেটি কেড়ে নিয়েছে। তবে মালদ্বীপের সমাজজীবনে ভারতীয় প্রভাব এমন নড়বড়ে নয় যে মুইজ্জুর বিজয়ে তা পুরো ম্লান হয়ে যাবে। ইয়ামিনের শাসন থেকে মালদ্বীপকে বের করে নিয়ে আসা গেলে মুইজ্জুর বিজয়ও নিশ্চিতভাবে নয়াদিল্লির জন্য শেষ কথা নয়।
চীনের জন্যও মুইজ্জুর বিজয় চূড়ান্ত স্বস্তিকর কিছু নয়। শ্রীলঙ্কা ও নেপালের অভিজ্ঞতা থেকে তাদের ভালো শিক্ষা হয়েছে। লঙ্কায় রাজাপক্ষেরা এবং নেপালে কে পি শর্মা ওলির ইউএমএল দল বেইজিংয়ের ‘নির্ভরযোগ্য বন্ধু’ ছিল। সেই বন্ধুদের এক পক্ষ, রাজাপক্ষেদের অনেককে দেশই ছাড়তে হয়েছে। নেপালে ওলির ইউএমএল দলকে পার্লামেন্টে বসতে হলো বিরোধী শিবিরে। ‘ঠান্ডাযুদ্ধ’ যত উত্তাপ ছড়াচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় ভোটের রাজনীতির হিসাব তাতে এভাবে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
মুইজ্জু যদি মালেতে চীনাদের দুঃসময় কাটাতে সাহায্যও করেন, তবু ক্ষমতা নির্বিঘ্ন করতে তিনি হয়তো নয়াদিল্লির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করেও চলতে চাইবেন। বিরোধী দলের নেতা হওয়া এবং সরকারের প্রেসিডেন্ট হওয়ায় অনেক ব্যবহারিক ব্যবধান থাকে। সলিহ সরকারের মতো তিনি হয়তো সবকিছুতে ভারতের বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দেবেন না, তবে মালদ্বীপে ভারতের সামরিক প্রভাব কমানোর মতো স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন কি না, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। যদিও মূলত এই প্রশ্নেই ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সূত্রপাত।
২০২১ সালের নভেম্বরে ওই আন্দোলনকালে প্রেসিডেন্ট সলিহর প্রশাসন ভারতীয় সামরিক ‘সহযোগিতা’কে ‘দুর্যোগকালীন উদ্ধার তত্পরতার সামর্থ্য বাড়ানোর উদ্যোগ’ মাত্র বলেছিল। আর মুইজ্জু নির্বাচনের আগে এবং পরেও বলছেন, মালদ্বীপের মানুষ বিদেশি ফৌজ দেখতে চায় না। জনসমর্থন মুইজ্জুর দিকে বলে বার্তাটি স্পষ্ট। কিন্তু নয়াদিল্লির সঙ্গে মালদ্বীপের ব্যবসা-বাণিজ্যের যে ব্যাপকতা, তাতে ওই বার্তার পরও সবকিছু অনুমান করা যাচ্ছে না।
মে মাসে তামিলনাড়ু থেকে মালদ্বীপ পর্যন্ত সরাসরি নৌ–যোগাযোগ চালু হলো। এটি ভারত-মালদ্বীপ অর্থনৈতিক লেনদেন অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালে মালদ্বীপে ভারতীয় রপ্তানি ছিল ২৪২ মিলিয়ন ডলারের সমান। ২০২২ সালে সেটা ৫০০ মিলিয়ন ডলার ছুঁই ছুঁই করছিল। চলতি সরকারের আমলে ভারতের ৮০০ মিলিয়ন ডলার ঋণে প্রায় আটটি প্রকল্প নেওয়া হয়। এ রকম ‘বন্ধন’ থেকে চট করে বের হওয়া কঠিন।
আবার বৈদেশিক দেনা বাংলাদেশ-পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার মতো মালদ্বীপের জন্যও বিরাট এক বোঝা। চীন-ভারত ‘বন্ধু’ হিসেবে প্রচুর ঋণ ধরিয়ে দিয়েছে। ২০২০ সালে চীনের কাছে মালদ্বীপের দেনা ছিল তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি (বিবিসি, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২০)। যে দেশের জিডিপি ৫ বিলিয়ন ডলার, সেখানে কেবল এক দেশে তিন বিলিয়ন ডলার দেনা ভীষণ ভয় ধরিয়ে দেয়। দেনা জমছে ভারতের সঙ্গেও। এসব দেনা থেকে মুক্ত হওয়াই এখন মালদ্বীপের আসল ‘যুদ্ধ’।
দেনাদারদের সঙ্গে আবার বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা চরম। ২০২২ সালে ৪৯৫ মিলিয়ন ডলারের ভারতীয় পণ্য গ্রহণের বিপরীতে মালদ্বীপ পাঠাতে পেরেছে কেবল ৬ দশমিক ৪২ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অর্থাৎ পারস্পরিক ব্যবসায়ের ৯৮-৯৯ শতাংশ করছে কেবলই ভারত। চীনের বেলায় অবস্থা আরও করুণ। এ সময়ে চীন রপ্তানি করেছে ৪৫১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, নিয়েছে ৫৬ হাজার ডলারের পণ্য।
প্রশ্ন হলো, মুইজ্জু কি এ অবস্থা বদলাতে পারবেন? পর্যটন খাত চাঙা করা ছাড়া দেশটির সামনে বিকল্প কম। পর্যটনে ভারতীয় ভ্রমণকারীদের হিস্যা ইদানীং বেশ বাড়ছে। ভারতকে কোনো বিষয়ে চটানোর আগে মুইজ্জুকে এ–ও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে চীন-ভারতের বাইরে মুইজ্জুর আরেক বিকল্প যুক্তরাষ্ট্র। এশিয়ার সবচেয়ে ছোট এই দেশটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন খুবই উৎসুক।
কারণ, নিছকই চীন। যুক্তরাষ্ট্রের একদা মালদ্বীপ নিয়ে তাবৎ উদ্বেগ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। সেসব উদ্বেগ এখন অনেকটাই চাপা পড়েছে ভূরাজনীতির নিচে। যুক্তরাষ্ট্র নানাভাবে জানাচ্ছে মালদ্বীপ চাইলে পুরোনো ‘বন্ধু’দের বিকল্প হিসেবে পেতে পারে। এর মধ্যে আবার রুশরাও মালদ্বীপের পর্যটনশিল্পের বড় এক আকর্ষণ। মালদ্বীপের তাই কোনো একটি দিকে হেলে পড়ার সুযোগ কম, কিন্তু হেলে পড়তে হবেও।
এটাই দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনীতিবিদদের একালের চক্রাকার নিয়তি।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক