মিয়ানমারের একজন সেনাসদস্য
মিয়ানমারের একজন সেনাসদস্য

মিয়ানমারের ‘ওয়াটারমেলন’ গুপ্তচর: জান্তা বাহিনীর সদস্য হয়েও যাঁরা বিদ্রোহীদের পাশে

‘ওয়াটারমেলন’—বাংলায় যার অর্থ করলে দাঁড়ায় ‘তরমুজ’। বাইরে সবুজ, ভেতরটা টকটকে লাল। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই ‘ওয়াটারমেলন’ নামে পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁরা দেশটির গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ে অংশ নেওয়া বিদ্রোহীদের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করছেন। বাইরে থেকে তাঁরা সামরিক বাহিনীর প্রতি অনুগত হলেও ভেতরে–ভেতরে কাজ করছেন বিদ্রোহীদের হয়ে, যাঁদের প্রতীকী রং লাল।

মিয়ানমারের সেনাসদস্যদের অনেকের বিদ্রোহীদের পক্ষে কাজ করার তথ্য উঠে এসেছে বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের অনুসন্ধানে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশটিতে জান্তা বাহিনীর সঙ্গে গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে। এর মধ্যে গত ১২ মাসে গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সেনাবাহিনী। মিয়ানমারের এক–চতুর্থাংশের কম অঞ্চল বর্তমানে তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, এরপরও মানুষের জন্য ‘খুবই বিপজ্জনক’ এই জান্তা।

গুপ্তচরবৃত্তি করা এমনই একজন সেনা কর্মকর্তা মেজর কিয়াও (ছদ্মনাম)। জান্তা বাহিনীর নৃশংসতার কারণে পক্ষ ত্যাগ করেছেন তিনি। কিয়াও বলেন, ‘নির্যাতনের শিকার বেসামরিক লোকজনের শরীরের আঘাতগুলো আমি দেখেছি। আমার চোখে পানি চলে এসেছিল। নিজের দেশের মানুষের প্রতি তারা কীভাবে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? আমাদের বেসামরিক লোকজনকে রক্ষা করার কথা ছিল। তবে আমরা এখন মানুষ হত্যা করছি। এটা এখন আর সেনাবাহিনী নেই, সন্ত্রাসী দলে পরিণত হয়েছে।’

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে জান্তা। জাতিসংঘের হিসাবে, তখন থেকে দেশটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়েছে। হত্যার শিকার হয়েছেন হাজার হাজার বাসিন্দা। জান্তা সরকারের এই নৃশংসতার জেরে শুরু হয় বিক্ষোভ। পরে তা রূপ নেয় সশস্ত্র লড়াইয়ে। পরে সেই লড়াইয়ে যোগ দেয় বিভিন্ন রাজ্যের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো।

মেজর কিয়াও প্রথমে ভেবেছিলেন বিদ্রোহীদের পক্ষে সরাসরি লড়াইয়ে অংশ নেবেন। পরে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন, গুপ্তচর হয়ে কাজ করলে তা এই ‘বিপ্লবে’ সবচেয়ে বেশি কাজে আসবে। এরপর নিরাপদ সময়ে বেসামরিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেটওয়ার্ক পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেসের (পিডিএফ) কাছে সামরিক বাহিনীর তথ্য ফাঁস করেন। এই তথ্য ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা সামরিক বাহিনীর ওপর হামলা চালান বা নিজেদের সুরক্ষা করেন। অস্ত্র কেনার জন্য বিদ্রোহীদের নিজের বেতনের কিছু অংশও দেন কিয়াও।

মিয়ানমারের বড় একটি অঞ্চল এখন বিদ্রোহীদের দখলে

বাড়ছে ‘ওয়াটারমেলনের’ সংখ্যা

গত নভেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ মিয়ানমারের ১৪ হাজারের বেশি গ্রাম নিয়ে একটি জরিপ করেছিল বিবিসি। এসব গ্রাম কাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তা যাচাই করে দেখা হয়েছে ওই জরিপে। দেখা গেছে, সংঘাত শুরুর প্রায় চার বছর পর মিয়ানমারের মাত্র ২১ শতাংশ ভূখণ্ডে সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আর ৪২ শতাংশ ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বাহিনী এবং বিভিন্ন প্রতিরোধী গোষ্ঠীর জোট। বাকি অঞ্চলগুলোয় দুই পক্ষের লড়াই চলছে। এমন পরিস্থিতিতে চলতি বছরের শুরুর দিকে নিজেদের পিছু হটার কথা স্বীকার করেন জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং।

এদিকে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদ্রোহীদের সঙ্গে আরও বেশি ‘ওয়াটারমেলন’ বা গুপ্তচর সেনাসদস্য যোগ দিচ্ছেন। এসব গুপ্তচরদের নিয়ে কাজ করার জন্য এবং আরও গুপ্তচর সংগ্রহের জন্য দুই বছর আগে একটি বিশেষ দল গঠন করেন বিদ্রোহীরা। সেই দলের একজন উইন আউং (ছদ্মনাম)। তিনি ওয়াটারমেলনদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন, সেগুলো যাচাই করেন এবং সংশ্লিষ্ট বিদ্রোহী নেতাদের কাছে পাঠিয়ে দেন।

গুপ্তচরবৃত্তির জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে ওয়াটারমেলনদের। জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী—দুই পক্ষকে নিয়েই তাঁদের শঙ্কায় থাকতে হয়।

উইন আউং ছিলেন মিয়ানমারের একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর বিদ্রোহীদের পক্ষ নেন তিনি। আউং বলেন, প্রতি সপ্তাহেই নতুন নতুন ওয়াটারমেলন বিদ্রোহীদের পক্ষে যোগ দিচ্ছেন। তাঁদের সংগ্রহ করার কাজে মূল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। এই ওয়াটারমেলনদের মধ্যে সেনাসদস্য থেকে উচ্চপর্যায়ের সামরিক কর্মকর্তারাও রয়েছেন। জান্তা সরকারের মন্ত্রিসভা থেকে শুরু করে গ্রামপ্রধানদের ভেতরেও এই গুপ্তচরেরা রয়েছেন।

একেকজন ওয়াটারমেলনের গুপ্তচরবৃত্তির পেছনে এক এক প্রেরণা কাজ করেছে। যেমন মেজর কিয়াও ক্ষোভ থেকে বিদ্রোহীদের কাছে তথ্যফাঁস করা শুরু করেছিলেন। আরেকজন হলেন নৌবাহিনীর করপোরাল মোয়ে (ছদ্মনাম)। ওয়াটারমেলন হওয়ার পেছনে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, পরিবারকে বাঁচানো। তাঁর স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। তিনি স্বামী মোয়েকে বলেন, বিদ্রোহীদের কাছে সেনাবাহিনী পরাজিত হতে চলেছে। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের তাঁকে নিহত হতে হবে। এরপরই পক্ষ বদলান মোয়ে।

গত ১২ মাসে মিয়ানমারে বড় অগ্রগতি পেয়েছেন বিদ্রোহীরা

ওয়াটারমেলনদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহীদের নেতা দায়েভা। তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় শহর ইয়াঙ্গুন দখল করা। এই শহর এখনো জান্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দায়েভা বলেন, ‘মুখে যতটা বলা সহজ, হামলা চালিয়ে ইয়াঙ্গুন দখল করা তত সহজ নয়। শত্রুরা অত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না।’

জান্তা বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে ইয়াঙ্গুনে সরাসরি প্রবেশ করতে পারছেন না বিদ্রোহীরা। তাই জঙ্গলের ভেতরে নিজেদের ঘাঁটি থেকে শহরটিতে গোপন হামলা চালানোর নির্দেশ দেন দায়েভা। এ কাজে ব্যবহার করেন ওয়াটারমেলনদের দেওয়া তথ্য। গত আগস্টেই এমন এক হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। ওই হামলা সম্পর্কে দায়েভা বিবিসিকে বিস্তারিত জানাননি। এটুকু বলেছিলেন, সামরিক বাহিনীর একজন কর্নেলকে হত্যা করতে ওই হামলা চালানো হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা একেবারে শূন্য থেকে শুরু করেছিলাম। এখন আমরা কতটা সফল, তা দেখে নিন।’

কত দিন এভাবে চলবে, তা নিয়ে ভয় রয়েছে কিয়াওয়ের মনে। শঙ্কা হয় একদিন হয়তো মা-বাবাকে ছেড়ে যেতে হবে।

‘কোনো দ্বিধা করবেন না, গুলি চালিয়ে দেবেন’

গুপ্তচরবৃত্তির জন্য মূল্য দিতে হচ্ছে ওয়াটারমেলনদের। জান্তা বাহিনী ও বিদ্রোহী—দুই পক্ষকে নিয়েই তাঁদের শঙ্কায় থাকতে হয়। যেমন শঙ্কায় রয়েছেন নৌবাহিনীর সদস্য মোয়ে। তাঁকে ইয়াঙ্গুন থেকে সীমান্তবর্তী অঞ্চল রাখাইনে মোতায়েন করা হয়েছিল। সেখানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর যোদ্ধাদের সঙ্গে লড়ছে সামরিক বাহিনী। রাখাইনে গিয়েও বিদ্রোহীদের গোপন তথ্য দিয়েছেন মোয়ে। তবে মনে একটি ভয় ছিল—ওই তথ্য ব্যবহার করে বিদ্রোহীরা হামলা চালালে শিকার হতে পারেন তিনিও।

যেমন চলতি বছরের মার্চ মাসে সাগরে নোঙর করে রাখা একটি জাহাজে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানো হয়েছিল। ওই জাহাজে ছিলেন মোয়ে। হামলায় তাঁর সাত সহকর্মী নিহত হন। মোয়ে বলেন, ‘পালিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। মনে হচ্ছিল আমরা খাঁচায় বন্দী ইঁদুর।’

বিষয়টি স্বীকার করেছেন উইন আউং। তিনি বলেন, ‘গুপ্তচরদের রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের ক্ষমতা সীমিত। আমরা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে পারি না যে তাঁরাই ওয়াটারমেলন। আর সামরিক বাহিনীর নির্দিষ্ট কোনো দলের ওপর হামলা করা থেকে আমাদের যোদ্ধাদের বিরত রাখতে পারি না।’ বিষয়টি ওয়াটারমেলনদের জানিয়েছিলেন উইন আউং। এটা শোনার পরও নাকি তাঁরা বিচলিত হননি। ওয়াটারমেলনদের অনেকে বলেছিলেন, ‘ওই মুহূর্ত এলে কোনো দ্বিধা করবেন না, গুলি চালিয়ে দেবেন।’

সামরিক বাহিনীও ওয়াটারমেলনদের প্রতি খড়্গহস্ত হয়েছে। মেজর কিয়াও বলেন, ‘যখন শুনলাম আমাদের নির্মূলের জন্য জান্তা বাহিনী মাঠে নেমেছে, কিছু সময়ের জন্য বিরতি নিয়েছিলাম।’

মিয়ানমারে কখন এই বিপ্লব শেষ হবে, সেই অপেক্ষায় রয়েছেন কিয়াও। তিনি বলেন, গুপ্তচর হিসেবে নিজের তৎপরতা গোপন রাখার জন্য মুখে মুখে সব সময় সামরিক বাহিনীর এককাট্টা সমর্থন দিয়ে এসেছেন। তবে কত দিন এভাবে চলবে, তা নিয়ে ভয় রয়েছে তাঁর মনে। শঙ্কা হয় একদিন হয়তো মা–বাবাকে ছেড়ে যেতে হবে।

যখন বিপ্লব শেষ হবে, বিদ্রোহীরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হবে, তখন কিয়াও ও মোয়ের মতো ওয়াটারমেলনদের কথা ভুলবেন না উইন আউং। এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাব। পরবর্তী জীবনে তাঁরা যা করতে চান, সেই অনুমতি দেব।’