বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে শ্রীলঙ্কার মতো সংকট হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থার প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত শনিবার বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের মাত্রা উচ্চ এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত, তারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। তাদের জন্য শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটি সতর্কসংকেত।
আইএমএফ প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে ঝুঁকিতে থাকা তেমন কয়েকটি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের পর বছর ধরে বিপুল পরিমাণ ঋণ করেছে শ্রীলঙ্কা। গত মাসে দেশটি বৈদেশিক মুদ্রা পরিশোধের ক্ষেত্রে নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। এশিয়া–প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে গত ২০ বছরে দেউলিয়া হওয়া প্রথম দেশ এটি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতি, মুনাফার হার বৃদ্ধি, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, উচ্চমাত্রার ঋণ ও বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মতো এসব বৈশ্বিক প্রতিকূলতা এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলতে পারে।
আইএমএফ প্রধান বলেছেন, অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও চার মাস ধরে টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে। এতে তাদের উন্নত অর্থনীতিকে ছোঁয়ার স্বপ্ন ঝুঁকিতে পড়েছে।
এসব উন্নয়নশীল দেশের কয়েকটিতে ঋণদাতা হিসেবে চীনের আধিপত্য রয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, এসব দেশের ভাগ্যকে গুরুত্বপূর্ণ উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে বেইজিং। তবে চীনের ঋণের শর্তগুলো কী এবং কীভাবে তারা ঋণ পুনর্গঠন করবে, তা অনেকটাই অস্পষ্ট।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের বিশ্লেষক অ্যালান কিনান মনে করেন, এ ক্ষেত্রে চীনের দায় রয়েছে। দেশটি এমন সব ব্যয়বহুল অবকাঠামো প্রকল্পকে উদ্বুদ্ধ করছে, যার বদলে কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক অর্জন আসছে না।
বাংলাদেশে গত মে মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম এং তান বিবিসিকে বলেন, আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।
কিম এং তান আরও বলেন, বাংলাদেশকে সরকারি ব্যয়ের বিষয়টিকে পুনঃ অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং ভোক্তা পর্যায়ে কেনাকাটার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে।
পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওসে ৭৫ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এ দেশটি কয়েক মাস ধরে বিদেশি ঋণ শোধ করতে না পেরে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। ইউক্রেনে রুশ অভিযান শুরুর পর দেশটিতে তেলের দাম বেড়েছে, বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দামও।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, লাওসে জ্বালানি সংগ্রহের জন্য মানুষকে দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। কোনো কোনো পরিবার তাদের বিল চুকাতে পারছে না।
চলতি বছর লাওসের মুদ্রা কিপের মান মার্কিন ডলারের তুলনায় এক শতাংশের বেশি কমেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ মুনাফা হারের কারণে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। আর তাতে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে ও ঋণের বোঝা বাড়ছে। আমদানি খরচ বেড়ে গেছে।
ইতিমধ্যে অনেক ঋণের মধ্যে থাকা লাওসকে ঋণ শোধ ও জ্বালানি আমদানির খরচ মেটাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, গত বছরের ডিসেম্বরে দেশটির রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
তবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেশটিকে একই পরিমাণে ঋণ শোধ করে যেতে হবে, যা দেশটির মোট দেশজ রাজস্বের প্রায় অর্ধেক। গত মাসে মুডি’স ইনভেস্টর সার্ভিস তাদের করা ঋণসংক্রান্ত ঝুঁকির দেশের তালিকায় লাওসকে ‘জাংক’ ক্যাটাগরিতে রেখেছে। জাংক ক্যাটাগরিতে ঋণকে উচ্চ ঝুঁকি বলে বিবেচনা করা হয়।
জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও রেলওয়ের মতো বড় বড় প্রকল্পগুলোর জন্য সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লাওসকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ দিয়েছে চীন। লাওসের কর্মকর্তাদের বক্তব্যের বরাতে চীনের রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা সিনহুয়া বলেছে, গত বছর ১ হাজার ৬০০ কোটি ডলার মূল্যের ৮১৩ প্রকল্পে একাই অর্থায়ন করেছে বেইজিং।
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে লাওসের সরকারি ঋণের পরিমাণ ছিল দেশটির মোট জিডিপির ৮৮ শতাংশ। এ ঋণের প্রায় অর্ধেকই চীনের কাছ থেকে নেওয়া।
বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, দেশটিতে কয়েক বছর ধরে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা চলছে। ১৯৭৫ সাল থেকে দেশটিতে একটি দলই (লাও পিপল’স রেভল্যুশনারি পার্টি) ক্ষমতায় আছে।
তবে চীনের সঙ্গে লাওসের বাণিজ্য বৃদ্ধি ও জলবিদ্যুৎ রপ্তানিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে মুডি’স অ্যানালিটিকস। সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে অর্থনীতিবিদ হেরন লিম বলেছেন, বিপজ্জনক অবস্থা এড়াতে লাওসকে ব্যাপক সংগ্রাম করতে হবে এবং বেলআউটের দরকার হবে।
মে মাসের শেষ থেকে পাকিস্তানে জ্বালানির দাম প্রায় ৯০ শতাংশ বেড়েছে। সরকার জ্বালানি ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়ার পর এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়। দেশটি এখন তাদের খরচের লাগাম টানতে চাইছে। একটি বেলআউট কর্মসূচি শুরু করতে আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করছে তারা।
পণ্যের দাম ক্রমাগত বাড়ছে। জুন মাসে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার ২১ দশমিক ৩ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ১৩ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
শ্রীলঙ্কা ও লাওসের মতো পাকিস্তানেও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে। গত বছরের আগস্ট থেকে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে গেছে।
এক বছরের জন্য বড় আকারের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর ১০ শতাংশ কর আরোপ করেছে পাকিস্তান সরকার। এর মধ্য দিয়ে ১৯৩ কোটি ডলার পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে সরকারের রাজস্ব ও খরচের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করা হবে। দেশটির কাছে আইএমএফের দেওয়া শর্তগুলোর মধ্যে এটি একটি।
এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু উড বিবিসিকে বলেন, তারা যদি এসব তহবিল সংগ্রহ করতে পারে, তবে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো ঋণসীমা বাড়াতে আগ্রহী হতে পারে।
পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এ ধরনের কিছু সমস্যার সমাধান করবেন বলে অঙ্গীকার করেছিলেন। তবে তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।
গত মাসে পাকিস্তান সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দেশটির জনগণকে চা খাওয়ার পরিমাণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাকিস্তান বিশ্বের সবচেয়ে বড় চা আমদানিকারক দেশ। চা আমদানির জন্য বছরে ৫১ কোটি ৫০ লাখ ডলার পরিমাণ অর্থ খরচ করেছে দেশটি।
এখানে চীনের ভূমিকা আছে। পাকিস্তান তাদের মোট ঋণের এক চতুর্থাংশের বেশি চীনের কাছ থেকে নিয়েছে।
মালদ্বীপে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি ঋণের পরিমাণ বাড়তে দেখা গেছে। এ ঋণের পরিমাণ তাদের জিডিপির তুলনায় ১০০ শতাংশের বেশি।
পর্যটন খাতের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল এ দেশের অর্থনীতিতেও করোনা মহামারির প্রভাব পড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, দ্বীপ রাষ্ট্রটি সুনির্দিষ্টভাবে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিজনিত ঝুঁকিতে আছে। কারণ, দেশটির অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগ ব্যাংক জেপি মরগ্যান বলছে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে আছে মালদ্বীপ।