ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়ি বানিয়ে দেবে তুরস্ক সরকার

ধ্বংসস্তূপ থেকে বের করে আনা হচ্ছে মরদেহ। গতকাল তুরস্কের হাতায় প্রদেশে
ছবি: এএফপি

অক্ষত ভবন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে। ৬ ফেব্রুয়ারির ভূমিকম্পে এই অঞ্চলের প্রতিটি শহর ধংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভূমিকম্পের পরপরই তুরস্কের এসব শহর পুনর্নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। সেই পথে হাঁটতে শুরু করল দেশটি। প্রশাসন ঘোষণা দিয়েছে, যেসব ভবনের বেশির ভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো একেবারে গুঁড়িয়ে দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে।

এদিকে তুরস্কে অভিযান প্রায় শেষ মুহূর্তে এসে গতকাল বুধবার কাহরামানমারাস শহর থেকে দুই নারীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁদের একজনের বয়স ৪২ বছর। তাঁর নাম মেলিকে ইমামোগ্লু। এ ছাড়া একই শহর থেকে ৭৪ বছর বয়সী আরেক নারীকে উদ্ধার করা হয়েছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দুই দেশ সিরিয়া ও তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ৪১ হাজার ছাড়িয়েছে।

এই দুই দেশে ঠিক কী পরিমাণ মানুষ নিখোঁজ, তা এখনো জানা যায়নি। গত মঙ্গলবার রাতে এরদোয়ান জানিয়েছেন, ভূমিকম্পে ১ লাখ ৫ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। এ ছাড়া ১৩ হাজার মানুষ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

যেভাবে চলবে পুনর্নির্মাণকাজ

ভূমিকম্পে তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে অন্যতম হাতায় প্রদেশ। সরকার বলছে, সেখানকার শহরগুলোর অর্ধেকের বেশি ভবন হয় ধসে গেছে, নয়তো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া অনেক ভবন এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো ব্যবহারোপযোগী করার কোনো উপায় নেই।

এ প্রসঙ্গে তুরস্কের পরিবেশ ও গৃহায়ণবিষয়ক মন্ত্রী মুরাত কুরুম এক টুইট বার্তায় জানিয়েছেন, ‘যেসব ভবন একবারে গুঁড়িয়ে দেওয়া দরকার, সেগুলো দ্রুত গুঁড়িয়ে দেব আমরা। এসব স্থানে নিরাপদ বাড়ি নির্মাণ করা হবে।’

এ নিয়ে তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (এএফএডি) সদর দপ্তরে মঙ্গলবার রাতে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন এরদোয়ান। সেখানে তিনি বলেন, যেসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, এক সপ্তাহের মধ্যে সেগুলো নিয়ে পর্যালোচনা শেষ হবে। কয়েক মাসের মধ্যে নতুন ভবন নির্মাণকাজ শুরু হবে।

এরদোয়ান আরও বলেন, ‘যেসব বাড়ি, অফিস ধসে গেছে, সব আমরা পুনর্নির্মাণ করব। এরপর ভবনের মালিকের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করা হবে।’

তুরস্কের ব্যবসায়ীদের সংগঠন এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড বিজনেস কনফেডারেশন জানিয়েছে, ভূমিকম্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে খরচ হবে সাত হাজার কোটি ডলার।

উদ্ধারকর্মীরা ফিরে যাচ্ছেন

বিভিন্ন দেশ থেকে যাঁরা উদ্ধারকাজে অংশ নিতে তুরস্ক ও সিরিয়ায় গিয়েছিলেন, তাঁরা নিজেদের কার্যক্রম প্রায় গুটিয়ে নিয়েছেন। অনেক উদ্ধারকর্মী ইতিমধ্যে ফিরে গেছেন নিজ দেশে। বাকিরা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন।

তবে উদ্ধারকাজ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক। মঙ্গলবার রাতে মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর এরদোয়ান বলেন, ‘ধসে যাওয়া ভবনের নিচে পড়ে থাকা শেষ নাগরিকটিকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত আমরা অভিযান চালিয়ে যাব।’

এ জন্য কোনো সময়সীমা তিনি অবশ্য বেঁধে দেননি। যদিও বিশেষজ্ঞরা আগেই বলেছিলেন, ভূমিকম্পের পর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জীবিত মানুষ উদ্ধারের সম্ভাবনা বেশি। এরপর সময় সময় যত গড়ায়, জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা তত কমে আসে। সেই হিসাবে ভূমিকম্পের ৯ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর কজন জীবিত উদ্ধার করা যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।

ঘরে ফেরার আহ্বান

তুরস্কে ভূমিকম্পের পর থেকে মানুষ আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকে মানসিক বৈকল্যে ভুগছেন। অনেকের বাড়ি বসবাসের উপযোগী থাকলেও আকাশের নিচে রাত্রি যাপন করছেন। কারণ, আবারও ভূমিকম্প হতে পারে, এই ভয়ে অনেকেই ঘরে ফিরছেন না। তবে সরকার এখন চাইছে, বাড়ি বসবাসের উপযোগী রয়েছে, এমন মানুষেরা ঘরে ফিরে যাক।

এ নিয়ে কথা বলেছেন তুরস্কের পর্যটনবিষয়ক মন্ত্রী নুরি এরসয়। পূর্ব আনাতোলিয়ার মালাতিয়া শহরে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করছে। যাঁদের ঘরবাড়ি বসবাসের উপযোগী রয়েছে, তাঁদের বাড়ি ফেরার ব্যাপারে উৎসাহিত করছে সরকার।

সিরীয়রা অসহায়

সিরিয়ার বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলগুলো গৃহযুদ্ধ শুরুর পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত। বোমা হামলা, সংঘর্ষ, গোলাগুলি—এসব তাদের নিত্যদিনের ঘটনা ছিল। এই ভূমিকম্পের আগে থেকেই সেখানকার ৪০ লাখ মানুষের ত্রাণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু এবারের ভূমিকম্পের পর সেই সংখ্যা আরও ব্যাপকভাবে বেড়েছে। তবে রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে অনেক দেশই সিরিয়ার পাশে দাঁড়ায়নি।

এ প্রসঙ্গে সিরিয়ার ইদলিবের বাসিন্দা আবদুল রহমান মোহাম্মদ বলেন, ‘যিনি কিনা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন এবং শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন, তাঁর যদি প্রতিদিন ১০ ডলার লাগে এবং তিনি যদি খুব কম দিনই এই পরিমাণ অর্থ আয় করতে পারেন, তবে এ পরিস্থিতি থেকে তিনি কীভাবে বের হবেন?’ আবদুল রহমান বলেন, ‘পরিস্থিতি আসলেই খারাপ।’

এদিকে সিরিয়ার বিদ্রোহী–নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে ত্রাণ ও সরঞ্জাম নিয়ে জাতিসংঘের গাড়ি পৌঁছাতে শুরু করেছে। কিন্তু উদ্ধার অভিযান চালানোর মতো ভারী কোনো যন্ত্র তাতে ছিল না। কিন্তু ভূমিকম্পের পর থেকে উদ্ধারকাজের জন্য ভারী যন্ত্র চাইছিল হোয়াইট হেলমেটস। সিরিয়ার ওই অঞ্চলে উদ্ধার অভিযানের জন্য পরিচিত এই সংগঠনের প্রধান রায়েদ সালেহ বলেন, দ্রুত কাজ করা গেলে আরও জীবিত মানুষ উদ্ধার করা সম্ভব হতো।

এমন একজন ভুক্তভোগী ইদলিবের ওয়ালিদ ইব্রাহিম। তাঁর অনেক স্বজনকে এখনো উদ্ধার করা যায়নি। ধংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে অনেকেই চিৎকার করছিলেন, ‘আমাদের উদ্ধার করুন, আমাদের উদ্ধার করুন। কিন্তু আমাদের হাতে কিছু্‌ই নেই, যা দিয়ে তাঁদের উদ্ধার করা যায়।’