ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তাঁর দেশ রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি চায়। জাপানের বার্তা সংস্থা কিওদো নিউজকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে হারানো ভূখণ্ড ফিরে পাওয়া তাঁর দেশের জন্য কঠিন হবে বলেও স্বীকার করেছেন তিনি।
আজ সোমবার জাপানের স্থানীয় সময় দুপুরের পর জেলেনস্কির সাক্ষাৎকারটি প্রচার করা হয়। সাক্ষাৎকার নিতে ইউক্রেনের রাজধানীতে অবস্থিত প্রেসিডেন্ট ভবনে গিয়েছিলেন বার্তা সংস্থা কিওদোর সাংবাদিক গেনইচিরো কোদামা। জেলেনস্কি বলেন, ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ লাভ করার পর আলোচনার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার কাছ থেকে ভূখণ্ড ফিরে পেতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবেন তিনি।
পূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনীর দ্রুত অগ্রসর হওয়ার কথা উল্লেখ করে জেলেনস্কি বলেন, পশ্চিমা মিত্রদের কাছ থেকে পাওয়া সাহায্য পর্যাপ্ত ছিল না। ইউক্রেন এখন ন্যাটোর সামরিক জোটে যোগ দিয়ে সেই চেষ্টা করে যাবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সামরিক বাহিনীর সেই শক্তির ঘাটতি রয়েছে এবং সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানের পথ আমাদের অবশ্যই খুঁজে দেখতে হবে।’
সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হওয়ার ঠিক পরপর অনেকেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সরাসরি স্বীকারোক্তিতে কিছুটা অবাক হয়েছেন। এ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে, কেন তিনি জাপানের বার্তা সংস্থাকে এতটা গুরুত্বপূর্ণ বার্তা প্রদানের জন্য বেছে নিলেন? কেনই–বা কিওদো নিউজ জেলেনস্কির সাক্ষাৎকার নিতে কিয়েভে নিজেদের সাংবাদিক দল পাঠাল।
ইউক্রেনের হঠাৎ করে এ অবস্থান বদল সম্পর্কে বলা যায়, সম্প্রতি বিশ্বরাজনীতির কিছু রদবদল ও যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে দেখা দেওয়া হতাশা জেলেনস্কিকে অবশ্যই প্রভাবিত করে থাকবে। এক মাস পর ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। তিনি ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধের পরিসমাপ্তি টানতে নিজের ইচ্ছার কথা শুরু থেকেই বলে আসছেন। ফলে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এখন জো বাইডেনের শেষ মুহূর্তে দিয়ে যাওয়া ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান আসা সত্ত্বেও বুঝতে পারছেন তাঁর দেশের পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া অনেকটা আত্মঘাতী আকার নিতে পারে।
সেই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য জেলেনস্কি এমন একটি মাধ্যমের সন্ধান করছিলেন, যেটি পশ্চিমা আগ্রাসী সাংবাদিকদের চেয়ে অনেক বেশি নমনীয় অবস্থান থেকে তাঁর কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইবে। বলা যায়, কিওদো নিউজ জেলেনস্কির সামনে সেই সুযোগ খুলে দিয়েছে।
এ ছাড়া সম্প্রতি যুদ্ধ নিয়ে ইউক্রেনে চালানো বেশ কয়েকটি জনমত জরিপের ফলাফলও রয়েছে। গত ১৯ নভেম্বর প্রকাশিত গ্যালোপের জরিপে দেখা গেছে, ইউক্রেনের জনমত এখন ক্রমেই যুদ্ধের বিরুদ্ধে হেলে পড়ছে। নাগরিক জীবনে মৃত্যু আরও বেশি প্রকট আকার নিয়ে উপস্থিত হতে থাকায় যুদ্ধ ছাড়াও নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রেসিডেন্ট নিজেই হয়তো শঙ্কা বোধ করছেন।
গ্যালোপের জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ইউক্রেনের ৫২ শতাংশ নাগরিক এখন যত দ্রুত সম্ভব যুদ্ধের সমাপ্তি দেখতে চান; এমনকি রাশিয়ার দখল করে নেওয়া ভূখণ্ড ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করতে হলেও। অন্যদিকে মাত্র ৩৮ শতাংশ নাগরিক ভূখণ্ড ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। ২০২২ সালে চালানো জরিপে এই হার ছিল ৭৩ শতাংশ।
অন্য যে প্রশ্ন জাপানের কিছু কিছু সূত্র থেকে তুলে ধরা হচ্ছে, তা হলো, কিওদো নিউজ কেন এ সময়ে জেলেনস্কির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করতে এগিয়ে গিয়েছে। জাপানের বেলায় প্রশ্নের উত্তর অবশ্য অনেকটাই সহজ। উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রাশিয়ার পক্ষে যোগ দিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নিয়ে জাপান অনেকটাই উদ্বিগ্ন। ঘরের পাশের শত্রুদেশ সেখানে কতটা পারদর্শিতা দেখাচ্ছে এবং যুদ্ধের মোড় তা ঘুরিয়ে দিচ্ছে কি না, জাপান সেটা পরিষ্কারভাবে জানতে চায়।
পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম উত্তর কোরিয়ার সেনাদলের ব্যাপকভাবে হতাহত হওয়ার খবর প্রচার করে গেলেও যুদ্ধক্ষেত্রে ঠিক কী হচ্ছে, নিজের কৌশলগত অবস্থানের কারণেই জাপানের তা জানা দরকার।
কিওদোর প্রচারিত সাক্ষাৎকারের বর্ণনায় বড় এক অংশজুড়ে আছে উত্তর কোরিয়ার সামরিক উপস্থিতির বিষয়টি। কিওদোর সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জেলেনস্কি যেমন শুরুতেই বলেছেন, রাশিয়ার পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধ করার জন্য উত্তর কোরিয়ার যে সৈন্যদের পাঠানো হয়েছে, তাদের মধ্যে হতাহতের হার অনেক বেশি।
উত্তর কোরিয়ার ঠিক কতজন সৈন্যকে যুদ্ধ করার জন্য রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে, তার সঠিক সংখ্যা বলতে পারেননি জেলেনস্কি। তবে তিনি বলেছেন, সেখানে ১২ হাজারের মতো উত্তর কোরীয় সেনা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে কতজন যুদ্ধে নিহত কিংবা আহত হয়েছে, সেই সংখ্যা তিনি প্রকাশ করেননি। ফলে ধরে নেওয়া যায় উত্তর কোরিয়ার সেনাদের যুদ্ধে জড়িত হওয়া নিয়ে খুব বেশি অবগত নয় ইউক্রেন।
তবে জেলেনস্কি জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া থেকে আরও বেশি সৈন্য নিয়ে আসার জন্য তাদের সঙ্গে রুশ বাহিনী ভালো আচরণ করছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়েছেন যে উত্তর কোরিয়ার সামরিক বাহিনী যুদ্ধে জড়িত হওয়ার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ সম্পর্কে ভালো প্রশিক্ষণ হয়তো লাভ করতে পারবে। তবে তারা আগামীর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন তিনি। তা হলো ড্রোন, অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধে ব্যবহারের অন্যান্য অস্ত্র সম্পর্কে এরা আরও বেশি অবগত হয়ে উঠলে কেবল এশিয়া নয়, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে।