মিয়ানমারের পাসপোর্ট কার্যালয় ও বিদেশি দূতাবাসগুলোর সামনে আজকাল অপেক্ষমাণ মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যাচ্ছে। সেনাবাহিনীতে নিয়োগ এড়াতে দেশ ছাড়ছেন অনেকে। সম্প্রতি মান্দালয়ের একটি পাসপোর্ট কার্যালয়ের সামনে মানুষের ভিড় এতটাই ছিল যে সেখানে পদদলিত হয়ে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। অনেকে আহত হয়েছেন।
মিয়ানমারে জান্তা সরকার সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদানের আইন কার্যকর করার পর থেকে যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, তারই কিছু নমুনা এগুলো।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির ক্ষমতা দখল করে। দেশটির নির্বাচিত নেতাদের কারাবন্দী করা হয়। তখন থেকে দেশটিতে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ চলছে। এ ঘটনায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘের হিসাবমতে, প্রায় ২৬ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
সম্প্রতি মিয়ানমারে তরুণ–তরুণীদের বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদান–সংক্রান্ত একটি আইন কার্যকর করা হয়েছে। অনেকের ধারণা, সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় বিদ্রোহী ও সরকারবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর হামলার কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ায় এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
রবার্ট নামের ২৪ বছর বয়সী এক অধিকারকর্মী বিবিসিকে বলেন, ‘এ সময়ে সামরিক বাহিনীর হয়ে কাজ করার কোনো অর্থ হয় না। আমরা বিদেশি আক্রমণকারীদের সঙ্গে যুদ্ধ করছি না। নিজেরাই একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি। আমাদের সামরিক বাহিনীতে যোগদানের অর্থ দাঁড়াবে, আমরাও নৃশংস কর্মকাণ্ডে ভূমিকা রাখছি।’
এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের নাগরিকদের অনেকেই এখন দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছেন।
গত ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে ইয়াঙ্গুনে থাই দূতাবাসের সামনে ভিসাপ্রক্রিয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিল এমন এক কিশোরীর সঙ্গে বিবিসির কথা হয়। ওই কিশোরী তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলে, ‘আমি বিকেল সাড়ে তিনটায় সেখানে পৌঁছেছিলাম। ভিসার আবেদনের জন্য টোকেন সংগ্রহ করতে আগে থেকেই প্রায় ৪০ জন লাইনে দাঁড়ানো ছিলেন। এক ঘণ্টার মধ্যেই দূতাবাসের সামনে ৩০০-এর বেশি মানুষের ভিড় জমে যায়।’
ওই কিশোরী আরও বলেছে, লম্বা সময় ধরে অপেক্ষা করতে গিয়ে দূতাবাস ভিসাপ্রক্রিয়াই বন্ধ করে দেয় কি না, তা নিয়ে সে দুশ্চিন্তায় ছিল।
সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক যোগদান–সংক্রান্ত এই আইন প্রথম চালু হয় ২০১০ সালে। তবে এটি কার্যকর হয়েছে চলতি বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি। আইন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী সব পুরুষ এবং ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী সব তরুণীর দুই বছরের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের মুখপাত্র মেজর জেনারেল জ মিন তুন এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই আইন অনুসারে বর্তমানে দেশটির ৫ কোটি ৬০ লাখ জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশ সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য বলে বিবেচিত হবে।
পরে আবার জান্তা সরকার বলেছে, এই মুহূর্তে নারীদের এই আইনের অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা নেই। তবে এর সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
বিবিসি বার্মিজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র বলেছেন, এপ্রিলের মাঝামাঝি বার্মিজ নববর্ষ উদ্যাপনের পর সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে যোগ দেওয়ার জন্য দেশের নাগরিকদের ডাকা হবে। প্রথমে পাঁচ হাজার ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হবে।
গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ড্যানিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মিয়ানমার–বিষয়ক গবেষক জাস্টিন চেম্বার মনে করেন, বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া থেকে বেসামরিক তরুণদের দূরে রাখতে বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিধানটি কার্যকর করা হয়েছে।
জাস্টিন বলেন, ‘বাধ্যতামূলক এই নিয়োগের আইনটি কীভাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দুর্বলতার চিহ্ন হয়ে উঠেছে, তা আমরা বিশ্লেষণ করতে পারি। তবে এটি চূড়ান্ত অর্থে জীবন ধ্বংস করে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে চালু হয়েছে। কেউ কেউ পালিয়ে যেতে পারবেন। তবে অনেকে তাঁদের স্বদেশিদের বিরুদ্ধেই মানবঢাল হিসেবে কাজ করবেন।’
সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মিয়ানমার টিচার্স ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, জান্তা সরকার ২০২১ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের বরখাস্ত করেছে। লড়াই ও বিমান হামলার কারণে বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর কিছু স্কুল ধ্বংস হয়ে গেছে।
জান্তা সরকার বলেছে, সব ছেড়ে যাঁরা ধর্মীয় চর্চায় মনোনিবেশ করেছেন, বিবাহিত নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সামরিক চাকরির অযোগ্য ব্যক্তি ও নিয়োগ বোর্ড থেকে অব্যাহতি পাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে এ আইন কার্যকর হবে না। এ ছাড়া অন্য নাগরিকেরা আইন না মানলে তিন থেকে পাঁচ বছরের জেল–জরিমানা করা হবে।
মিয়ানমারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের কেউ কেউ লিখেছেন, সামরিক নিয়োগ এড়াতে তাঁরা সন্ন্যাসজীবন বেছে নিতে চান, কিংবা তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চান।
ধনীরা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দেশ ছেড়ে পালানোর পরিকল্পনা করছেন। তাঁদের অধিকাংশই থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরে চলে যেতে চান। কেউ কেউ আবার আইসল্যান্ডে পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে সেনা শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করা সংগঠন আল বার্মা ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট ইউনিয়নের নেতা অং সেত বলেছেন, অনেকে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার বদলে বিদ্রোহী দলে যোগ দিচ্ছে।
গত অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের জাতিগত বিদ্রোহী তিনটি গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স সমন্বিতভাবে অভিযান শুরু করে। তারা ভারত ও চীন সীমান্তবর্তী বেশ কিছু সামরিক ঘাঁটি দখল করে নিয়েছে। আবার বাংলাদেশ ও ভারতীয় সীমান্তবর্তী বিশাল এলাকায়ও জান্তা সরকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।
মিয়ানমারে জাতীয় ঐক্য সরকার (নির্বাসনে থাকা সরকার) বলছে, বর্তমানে দেশটির ৬০ ভাগের বেশি ভূখণ্ড বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর নিয়ন্ত্রণে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের বার্মা কর্মসূচিবিষয়ক কান্ট্রি ডিরেক্টর জেসন টাওয়ার বলেন, ‘জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে জান্তা বারবার অপদস্থ ও অপমানজনকভাবে হেরে যাওয়ার পর বাধ্যতামূলক নিয়োগের আইনটি কার্যকর করেছে সেনাবাহিনী। এতে প্রমাণিত হয়, সামরিক বাহিনী কতটা মরিয়া হয়ে উঠেছে।’
উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারের ফেলো ইয়ে মায়ো হেন বলেছেন, এই আইন কার্যকরের আগেও জোর করে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের ইতিহাস জান্তা সরকারের আছে।
মায়ে হেন মনে করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীতে জনবল যেহেতু অনেক কমে গেছে, সে ক্ষেত্রে সেনা নিয়োগের দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া চালানোর মতো সময় জান্তা সরকারের হাতে নেই। দ্রুত নিয়োগ দেওয়ার জন্যই কর্মকর্তারা আইনটি কার্যকরের জন্য প্ররোচিত হয়েছেন।