আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ
আফগানিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ

ফিরে দেখা

ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালাতে ব্যর্থ নাজিবুল্লাহর প্রাণ যায় তালেবানের হাতে

নবগঠিত আফগান গুপ্তচর সংস্থার প্রধান হয়ে নৃশংস দমনপীড়ন চালিয়ে কুখ্যাতি কুড়ান মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ। এই কুখ্যাতিই তাঁকে আরও ওপরে, ক্ষমতার শিখরে যাওয়ার পথ তৈরি করে দেয়।

অচিরেই সোভিয়েত নীতিনির্ধারকদের সুনজরে আসেন নাজিবুল্লাহ। অনুগত, বিশ্বস্ত, আস্থাভাজন হিসেবে তাঁকে আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদে বসান সোভিয়েতরা।

তবে ক্ষমতায় বসে নাজিবুল্লাহ বুঝতে পারেন, পরিস্থিতি জটিল। সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। তাঁকে ক্ষমতায় বসানো, সর্বাত্মক সমর্থন দেওয়া সোভিয়েতরা একসময় আফগানিস্তান ছাড়বে। তখন তাঁর কী হবে? ফলে এভাবে দিন যাবে না। বিদ্যমান ব্যবস্থায়, কাঠামোয় তাঁর শাসন বেশি দিন টিকবে না।

নাজিবুল্লাহ জাতীয় পুনর্মিলনের উদ্যোগ নেন। কমিউনিজম থেকে সরে আসেন। আফগান জাতীয়তাবাদের দিকে ঝোঁকেন। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন।

কিন্তু ফলাফল হয় শূন্য। সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়লে নাজিবুল্লাহ অসহায় হয়ে পড়েন। পরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে তিনি হয়ে যান ‘নিঃসঙ্গ’।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মাস কয়েকের মাথায় নাজিবুল্লাহ ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি পালিয়ে ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ব্যর্থ হন। আশ্রয় নেন জাতিসংঘের কম্পাউন্ডে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রায় সাড়ে চার বছরের মাথায় তিনি তালেবানের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।

ছাত্রজীবনে রাজনীতি শুরু

নাজিবুল্লাহর জন্ম ১৯৪৭ সালে, আফগানিস্তানের পাকতিয়া প্রদেশের গারদেজ শহরে। মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিকের পড়ালেখা যথাক্রমে আফগানিস্তানের কাবুল ও ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে।

১৯৬৪ সালে কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়ালেখা শুরু করেন নাজিবুল্লাহ। তিনি ১৯৭৫ সালে এমবিবিএস পাস করেন। তবে তিনি কখনো চিকিৎসক হিসেবে পেশাগত চর্চা (প্র্যাকটিস) করেননি।

কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৫ সালে নাজিবুল্লাহ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বামপন্থী পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তানে (পিডিপিএ) যোগ দেন।

১৯৬৭ সালে পিডিপিএ দুই ভাগে বিভক্ত হয়। পারচাম ও খালক। বাবরাক কারমালের নেতৃত্বাধীন পারচাম অংশে যোগ দেন নাজিবুল্লাহ। তিনি কারমালের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। নাজিবুল্লাহ তাঁর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্রাবস্থায় দুবার জেল খাটেন।

আফগানিস্তানের মোহাম্মদ দাউদ খানের সরকার উৎখাতে ১৯৭৭ সালে পিডিপিএর বিবদমান পক্ষগুলো নিজেদের মধ্যকার বিভেদ দূরে সরিয়ে রেখে এক লক্ষ্যে কাজ শুরু করে।

পিডিপিএর নেতৃত্বে ১৯৭৮ সালে আফগানিস্তানে সফল বিপ্লব হয়। দাউদ খানের সরকার উৎখাত করে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হয় কমিউনিস্ট পিডিপিএ। গঠন করা হয় বিপ্লবী পরিষদ। ক্ষমতাসীন বিপ্লবী এই পরিষদের সদস্য হন নাজিবুল্লাহ। একই বছর তাঁকে আফগান রাষ্ট্রদূত করে ইরানে পাঠানো হয়।

একপর্যায়ে পিডিপিএর দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। ক্ষমতার লড়াইয়ে পিডিপিএর খালক অংশ আধিপত্যশীল অবস্থানে চলে যায়। মাস কয়েকের ব্যবধানে নাজিবুল্লাহ বরখাস্ত হন। পরে তিনি ইউরোপে নির্বাসনে যান।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে কাবুল দখল করে তালেবান

‘কাবুলের কসাই’

আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে ‘রক্ষায়’ ১৯৭৯ সালে দেশটিতে ঢুকে (আগ্রাসন) পড়ে সোভিয়েত বাহিনী। তারা পিডিপিএর খালকপন্থী সরকার উৎখাত করে নিজেদের আস্থাভাজন পারচামপন্থী সরকারকে ক্ষমতায় বসায়। নতুন প্রেক্ষাপটে নাজিবুল্লাহ আফগানিস্তানে ফিরে আসেন। তাঁর রাজনৈতিক গুরু পারচামপন্থী নেতা কারমাল দল, রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান হন।

কারমাল সরকারের আমলে ১৯৮০ সালে সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির আদলে গড়ে তোলা হয় আফগান গুপ্তচর সংস্থা ‘খাদ’। নবগঠিত এই সংস্থার প্রধান নিযুক্ত হন নাজিবুল্লাহ। তাঁর নেতৃত্বে ‘খাদ’ একটি নৃশংস সংস্থায় পরিণত হয়। তিনি ‘কাবুলের কসাই’ নামে পরিচিতি পান।

কমিউনিস্ট সরকারের পাশাপাশি সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে আসছিলেন আফগান মুজাহিদীনরা। মুজাহিদীনসহ বিরোধীদের দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখছিল ‘খাদ’। নাজিবুল্লাহ তাঁর চরম দমন-পীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শীর্ষস্থানীয় সোভিয়েত কর্মকর্তাদের নজরে চলে আসেন।

উত্থান-পতন

নাজিবুল্লাহ ১৯৮১ সালে পিডিপিএর পলিটব্যুরোর সদস্য হন। পিডিপিএর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অধিক সময় ও মনোযোগ দিতে তিনি ১৯৮৫ সালে ‘খাদ’-এর প্রধানের পদ ছাড়েন। ১৯৮৬ সালে নাজিবুল্লাহ পিডিপিএর সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৭ সালে তাঁকে আফগান প্রেসিডেন্টের পদে বসায় সোভিয়েত।

ক্ষমতায় বসে নাজিবুল্লাহ দেশে শান্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন। পুনর্মিলনের লক্ষ্যে গঠন করেন জাতীয় আপস কমিশন। নতুন সংবিধান গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষমতা কমান। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেন। শিথিল করেন কঠোর নিয়ন্ত্রণ। মুজাহিদীনসহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে উদার মনোভাব দেখান। সরকারের পক্ষে জনসমর্থন অর্জনচেষ্টার অংশ হিসেবে তিনি আরও অনেক উদ্যোগ নেন। কিন্তু নানান কারণে তা শেষ পর্যন্ত কাজে আসেনি।

নাজিবুল্লাহর শাসনামলেই আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ১৯৮৯ সালে তা সম্পন্ন হয়। সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরই আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে নাজিবুল্লাহ তাঁর প্রধান ভরসার জায়গা হারান। তিনি কার্যত অসহায় হয়ে পড়েন। নিজ সরকার ও বাহিনীর মধ্যে বিরোধ-বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। অন্যদিকে আফগান মুজাহিদীনদের লড়াই আরও জোরদার হয়। সব মিলিয়ে তাঁর সরকার নড়বড়ে হয়ে যায়। বিশেষ করে জেনারেল আবদুল রশিদ দোস্তম পক্ষত্যাগ করলে নাজিবুল্লাহর বিদায়ঘণ্টা বেজে যায়। আফগান মুজাহিদীনদের রাজধানী কাবুল দখলের মুখে ১৯৯২ সালের ১৬ এপ্রিল নাজিবুল্লাহ পদত্যাগ করেন।

১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার শেষ হয়

ভারতে পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা

পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে নাজিবুল্লাহর পদত্যাগের আগেই তাঁর পরিবার বন্ধুপ্রতিম দেশ ভারতে পালিয়ে যায়। পদত্যাগের পরদিন ১৯৯২ সালের ১৭ এপ্রিল নাজিবুল্লাহ ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন।

গোপনে কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে একটি উড়োজাহাজে করে নাজিবুল্লাহর ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। বিমানবন্দরের রানওয়েতে অপেক্ষমাণ ছিল একটি উড়োজাহাজ। নাজিবুল্লাহর জন্য উড়োজাহাজের ভেতরে অপেক্ষায় ছিলেন জাতিসংঘের এক কর্মকর্তা।

তখন কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ করছিলেন দোস্তম। তাঁর অনুগত সেনারা বিমানবন্দরের বাইরে নাজিবুল্লাহকে আটকে দেন। পরে তিনি কাবুলে জাতিসংঘের কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেন।

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় নিরাপদে দেশ ছেড়ে ভারতে যেতে চেয়েছিলেন নাজিবুল্লাহ। কিন্তু তা হয়নি। আবার নানান ঝুঁকির দিক বিবেচনা করে নাজিবুল্লাহকে কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি নয়াদিল্লি।

১৯৯৪ সালে ভারত এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে আলোচনার জন্য কাবুল পাঠিয়েছিল। নয়াদিল্লির অনুরোধ সত্ত্বেও নাজিবুল্লাহকে দেশত্যাগের অনুমতি দেয়নি তৎকালীন আফগান কর্তৃপক্ষ। ফলে নাজিবুল্লাহকে কাবুলের জাতিসংঘ কম্পাউন্ডেই স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে থাকতে হয়।

নৃশংসভাবে হত্যা

নাজিবুল্লাহর পতনের পর আফগানিস্তানে শান্তি আসেনি। বরং বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে তীব্র লড়াই-সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় আফগান গৃহযুদ্ধ (১৯৯২-১৯৯৬) নামে পরিচিত এই সংঘাত পর্বে নতুন খেলোয়াড় হিসেবে ময়দানে আবির্ভূত হয় তালেবান। ১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত তালেবান অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাপক শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তারা আফগানিস্তানের একের পর এক এলাকা দখল করতে থাকে।

১৯৯৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে (২৬-২৭ সেপ্টেম্বর) তালেবান কাবুলে ঢুকে পড়ে। তালেবানের কাবুল দখলের জেরে জাতিসংঘ কম্পাউন্ড ফাঁকা হয়ে যায়। তবে তখনো কম্পাউন্ডের ভেতরে লুকিয়ে ছিলেন নাজিবুল্লাহ, তাঁর ভাই সাবেক নিরাপত্তাপ্রধান শাহপুর আহমেদজাই ও কয়েক সহযোগী।

১৯৯৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একদল তালেবান যোদ্ধা কম্পাউন্ডের ভেতরে প্রবেশ করেন। তাঁরা নাজিবুল্লাহকে নৃশংস নির্যাতন করেন। তাঁকে খোজা করে দেন। তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তাঁর রক্তাক্ত দেহ ট্রাকের পেছনে বাঁধা হয়। এভাবে কাবুলের সড়কে তাঁর দেহ টেনে টেনে ঘোরানো হয়। একই পরিণতি ঘটে তাঁর ভাইয়ের। হত্যার পর নাজিবুল্লাহ ও তাঁর ভাইয়ের নিষ্প্রাণ দেহ প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের বাইরে ট্রাফিক লাইটের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। তালেবানের এই বর্বরতা, নৃশংসতা পুরো বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে।

তথ্যসূত্র: এনসাইক্লোপিডিয়া, ব্রিটানিকা, আল–জাজিরা, বিবিসি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, কোয়ার্টজ