সময়টা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মাসাও ইতোর বয়স তখন চার বছর। জাপানের হিরোশিমায় তাঁর বাড়ি। সাইকেল চালাতে পছন্দ করতেন মাসাও। সেদিন বাড়ির পাশে সাইকেল চালাচ্ছিলেন। ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি, কিছুক্ষণের মধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে যাচ্ছেন তিনি।
সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান থেকে হিরোশিমায় ফেলা হয় পারমাণবিক বোমা। ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ দেখে বিশ্ববাসী। প্রাণ হারায় লাখো মানুষ। ধ্বংস হয়ে যায় হিরোশিমা শহরের সিংহভাগ। তবে প্রাণে বেঁচে যান শিশু মাসাও। কিন্তু জীবনভর বয়ে বেড়াতে হয় সেই ধ্বংসের স্মৃতি ও করুণ অভিজ্ঞতা।
এই হামলায় ১২ বছর বয়সী এক ভাই ও ১০ বছরের এক বোনকে হারান মাসাও। তাঁর বয়স এখন ৮২ বছর ছুঁয়েছে। সম্প্রতি এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে মাসাও বলেন, ‘যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, ভয়াবহভাবে দগ্ধ হয়েছিলেন তাঁরা।’
মাসাও বলেন, সেদিন তাঁর মা–বাবা দগ্ধ অনেককে তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বাঁচানো যায়নি। একের পর এক মারা গেছেন তাঁরা। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে মৃতদের কবর দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা শহরে ছিল না। খোলা জায়গায় মরদেহ রাখার ফলে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছিল।
সাড়ে ছয় দশকের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও সেই অভিজ্ঞতা মনে করতে চান না মাসাও। তিনি বলেন, ‘সেটা দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা ছিল। তীব্র দুর্গন্ধে ভরে গিয়েছিল চারপাশ। আমি এটা ভুলে যেতে চাই।’
মাসাও ব্যাংকে চাকরি করতেন। এখন অবসর জীবন। প্রায় দুই দশক ধরে তিনি হিরোশিমার শান্তিস্তম্ভ ও জাদুঘরের জন্য স্বেচ্ছাসেবক গাইড হিসেবে কাজ করেছেন। পারমাণবিকবিরোধী প্রচারক হিসেবেও কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর।
শুধু হিরোশিমা নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরে নাগাসাকিতেও পারমাণবিক হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। হিরোশিয়ায় মারা যায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। আর নাগাসাকিতে প্রাণ যায় ৭৪ হাজার মানুষের। মাসাওয়ের মতো যাঁরা প্রাণে বেঁচে যান, তাঁরা ‘হিবাকুশা’ নামে জাপানি সমাজে পরিচিত হন। তাঁদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।
বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জোট জি৭-এর নেতারা হিরোশিমায় একত্র হচ্ছেন। ১৯ মে (আগামীকাল শুক্রবার) থেকে ২১ মে তিন দিনব্যাপী চলবে এই সম্মেলন। এ সময় নেতারা পারমাণবিক হামলার স্মৃতিতে নির্মিত স্তম্ভ পরিদর্শন করবেন। কথা বলবেন হিবাকুশাদের সঙ্গে।
এ বিষয়ে মাসাও বলেন, তিনি জি৭-এর নেতাদের সতর্ক করবেন। তাঁদের বলবেন, ‘আপনার কাছে যদি পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তবে আপনি তা ব্যবহার করতে প্রলুব্ধ হতে পারেন। এতে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তার চেয়ে ভালো এসব অস্ত্র না রাখা।’
যদিও মাসাও স্বীকার করছেন, পারমাণবিক অস্ত্রবিহীন একটি বিশ্ব কল্পনা করা ‘অসম্ভব আদর্শবাদী’ বলে মনে হতে পারে। তাঁর মতে, বিশেষ করে যখন রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দিচ্ছে এবং উত্তর কোরিয়া একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে মাসাওয়ের মতে, হিরোশিমা সম্মেলন থেকে জি৭-এর নেতারা পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বার্তা পাবেন। মাসাও বলেন, ‘যত দিন পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্র থাকবে, আপনার শহর হিরোশিমার মতো হওয়ার ঝুঁকিতে থাকবে। আপনি নিশ্চয়ই এমনটা ঘটতে দিতে চান না।’
পারমাণবিক বোমার তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে মাসাওয়ের শৈশব অন্য শিশুদের মতো স্বাভাবিক ছিল না। ঘটনার দিন বেঁচে গেলেও পরে তেজস্ক্রিয়তার জেরে মারা যান তাঁর বাবা। দেউলিয়া হয়ে পড়ে পরিবারটি। বন্ধ হয়ে যায় তাঁদের পারিবারিক ব্যবসাও।
ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে মাসাও ও তাঁর মা হিরোশিমা ছেড়ে যান। পরবর্তী সময় যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন মাসাও। একসময় মাসাও খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি তাঁর রাগ কখনোই কমেনি। হিরোশিমার ভয়াবহতার স্মৃতি দেখে মুষড়ে পরা আমেরিকানদের দেখে, তাঁদের সঙ্গে মিশে মাসাওয়ের রাগ ধীরে ধীরে কমে আসে।
মাসাও যখন হিরোশিমার শান্তিস্তম্ভ ও জাদুঘরের জন্য স্বেচ্ছাসেবক গাইড হিসেবে কাজ করেন, তখন অনেক শিশু, বিশেষ করে, স্কুলের শিক্ষার্থীরা সেখানে আসত। তিনি শিশুদের অনুপ্রেরণা জোগাতেন। তিনি বলতেন, ‘আমি চিরদিন এই কাজ করে যেতে পারব না। এখন তোমাদের পালা... পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব অর্জন করার।’