শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির হাল কোন দিকে

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির একটি চালিকা শক্তি চা–শিল্প
ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্টের ভাষায় দেশটি ‘দেউলিয়া’।
গেল বছরের মে মাসে ভারত মহাসাগরের এই দ্বীপদেশটি সার্বভৌম ঋণ পরিশোধে খেলাপি হয়ে পড়ে। এক গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায়। পরে দেশটি অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে থেকে ২৯৯ কোটি ডলারের ঋণ পায়। কিন্তু এ অর্থ এখনো ছাড় হয়নি। কারণ, দেশটির অন্যতম দুই ঋণদাতা চীন ও ভারতের কাছ থেকে দ্বিপক্ষীয় ঋণ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত আইএমএফ ঋণ ছাড় করবে না। তবে এতে কোনো অগ্রগতি নেই। তাই দেশটির মানুষের কষ্টও লাঘব হচ্ছে না।

আগামী কিছুদিনের মধ্যে শ্রীলঙ্কা আর্থিক সহায়তার অর্থ পেলেও দেশটির অর্থনীতির পুনর্গঠনের কাজ যে দ্রুত সম্ভব হবে, তা–ও বলা যাচ্ছে না। বরং এটা একটা শুরুমাত্র। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মডেলের একটা মৌলিক পরিবর্তন দরকার বলে মনে করা হয়।

অথচ শ্রীলঙ্কার বড় সম্ভাবনা ছিল

বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল টাইগারদের সঙ্গে ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের পর ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক দিক থেকে একধরনের ‘শান্তির লভ্যাংশ’ পায়। সেই সময় দেশটি বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। শুধু চীন নয়, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানও ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। অর্থনীতির এই প্রবাহ দেশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে। তবে এর ফলে নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতাও সৃষ্টি হয়। দেশটির রপ্তানি ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে ছয় শ ডলার কোটি থেকে বেড়ে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। ওই সময় দেশটির অর্থনীতিতে রপ্তানির অবদান ২৩ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ৩৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।

২০২০ সালে করোনা অতিমারি আঘাত হানার আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি ছিল। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এতটা জোরে ধাক্কা খাওয়ার একটি বড় কারণ এই ভারসাম্যহীনতা। এ সময় খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দেয়।

অর্থনীতির এই নাজুক অবস্থায় দেশটির রাজনীতি চরম সংকটে পড়ে। ব্যাপক জনবিক্ষোভ সামাল দিতে না পেরে গত বছরের জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশ ছেড়ে পালান। ক্ষমতায় আসেন রনিল বিক্রমাসিংহে। তাঁর কাছে এটি পরিষ্কার ছিল, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির উত্তরণ ঘটাতে হলে সংকটের উৎসে যে ভারসাম্যহীনতা, তা কমাতে হবে। মূল কথা, রপ্তানি বাড়াতে হবে। গত বছর শ্রীলঙ্কার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সভায় রনিল বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘আমাদের বড় ধরনের প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানিমুখী অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। এ ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের দেশ এটি। আমাদের দেশের বাইরের বাজার দেখতে হবে।’

এখন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় প্রশ্ন হলো, আদৌ কি শ্রীলঙ্কায় প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়েছে? দেশটি কি উন্নতির দিকে সত্যিই যাচ্ছে?

শ্রীলঙ্কার রপ্তানির প্রথাগতভাবে কৃষিপণ্যকেন্দ্রিক। ষোড়শ শতকে শ্রীলঙ্কার দারুচিনি ইউরোপীয় অনেক ঔপনিবেশিক শক্তিকে আকর্ষণ করেছিল। এখন দেশটির সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য হলো চা। তবে বাইরের দেশ থেকে রাসায়নিক সার আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে এ খাতে ২০২১ সালে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসে। উৎপাদন কমে যায় এক-পঞ্চমাংশ। ভবিষ্যতে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে নীতিনির্ধারকদের। দুই শতাব্দী পুরোনো চা–শিল্পে এখনো পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ চলে। হাত দিয়েই চা–পাতা তোলার রীতি চালু আছে।

চা–শিল্প

শ্রীলঙ্কার চা–শিল্পের শীর্ষে থাকা নুয়ারু এলিয়া এলাকার পেড্রো চা–বাগানের প্রধান রোশন রাজাদুরাই বলেন, প্রথাগত রীতির বাইরে তিনি নতুন ধারা আনতে চান চা–শিল্পে। কিন্তু শ্রমিকেরা এ ধারায় বাধার সৃষ্টি করছে।

চায়ের বাইরে শ্রীলঙ্কার রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে পোশাকশিল্প। কিন্তু এ শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানির জন্য দেশটিকে পুরোপুরি বাইরের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে কাঁচামালের দাম বেড়েছে ব্যাপকভাবে। এসব সামগ্রীর দাম কমলেও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির গতি আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।

তাহলে শ্রীলঙ্কা এখন কি রপ্তানি করতে পারে? মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো ইলেকট্রনিক সামগ্রীর উৎপাদন শ্রীলঙ্কায় হয় না। তাই এ ক্ষেত্রে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে প্রাণের সঞ্চার করতে পারে বন্দরগুলো। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান এসব বন্দরের ব্যবহার আরও বাড়ানোর উপযোগী।

শ্রীলঙ্কায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। ২০২২ সালের আগস্টে তোলা

বন্দর

শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে বলেন, ভারত মহাসাগরে যেখানে শ্রীলঙ্কার অবস্থান, সেখানে অন্য দেশের পণ্য পরিবহনের একটি কেন্দ্র হতে পারে দেশটি। এখানে বন্দর ও আনুষঙ্গিক সুবিধা আছে। এভাবে রপ্তানির গতিও বাড়তে পারে।

ধারণা করা হয়, ভারত মহাসাগর দিয়ে বিশ্বের খোলা পণ্যের এক-তৃতীয়াংশ পরিবহন হয়। কিন্তু জাতীয় পরিকল্পনার অভাবে এর সুযোগ নিতে পারছে না দেশটি। গত বছর অর্থনৈতিক সংকটের সময় মার্কিন ডলারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মূল্যমান অর্ধেকে নেমে যায়। এতে রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল।

দেশটির আরেকটি সংস্কারের দিক তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। সেটা হলো আমদানি শুল্ক কমানো। বেশি শুল্কের কারণে আমদানি পণ্যের দাম অনেক বেশি হয়ে যায়। ভোক্তা পণ্যে আমদানি শুল্ক আরোপের দিক থেকে শ্রীলঙ্কা বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষণশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে চিহ্নিত।

রপ্তানির ক্ষেত্রে এসব বাধা দূর করার উদ্যোগ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে। দেশের শিল্পকে আরও দক্ষ করতে পারে, সেই সঙ্গে বাড়তে পারে রপ্তানিও। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার বদলের পরও রনিল বিক্রমাসিংহে বাণিজ্যের বাধাগুলো দূর করার মতো রাজনৈতিক সমর্থন পাবেন কি না।

তবে আশার দিক হলো, গত বছরের ভয়াবহ পরিস্থিতির পর সংস্কারের ভাবনা এখন জোরোশোরেই ভাবা হচ্ছে।