ফায়াজ ও তাঁর স্ত্রী ভেবেছিলেন আর কিছুক্ষণ পরই তাঁরা নিরাপদ। ঠিক তখনই তাঁদের ওপর বোমা পড়তে শুরু করে। ‘আমরা যখন একে একে নৌকায় উঠছিলাম, তখনই তারা আমাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ শুরু করে’—বলছিলেন মিয়ানমারে বসবাসরত রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ফায়াজ। তিনি আরও বলেন, ‘৫ আগস্ট চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মোংডু শহরের নাফ নদের তীরে আসে হাজারো রোহিঙ্গা। সেদিন বিকেল পাঁচটার দিকে তাদের চিৎকার ও আর্তনাদে ওই এলাকার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।’
এর আগে রাখাইন রাজ্যের গ্রামগুলোয় হামলা চালানো হয়। এ পরিস্থিতিতে ফায়াজসহ হাজারো পরিবারের নিরাপদ আশ্রয়ের একমাত্র উপায় ছিল পশ্চিম মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের নিরাপদ উপকূলে পালিয়ে আসা।
সেদিন ফায়াজ সঙ্গে করে কয়েকটি ব্যাগ আনতে পেরেছিলেন। হাতের কাছে প্রয়োজনীয় যা পেয়েছেন, তা–ই নিয়েছেন সেসব ব্যাগে। তাঁর স্ত্রীর কোলে ছিল ছয় বছরের একটি কন্যাসন্তান। বড় মেয়েটি তাঁদের পাশেই দৌড়াচ্ছিল। তাঁদের থেকে একটু সামনে হাঁটছিলেন ফায়াজের শ্যালিকা। তাঁর কোলে ছিল আট মাসের শিশুসন্তান।
সেখানে প্রথম যে বোমাটি ফেলা হয়, সেটির আঘাতেই ঘটনাস্থলে নিহত হন ফায়াজের শ্যালিকা। তাঁর কোলের শিশুটি মারাত্মক আহত হলেও তখনো বেঁচে ছিল। ফায়াজ বলেন, ‘আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে নিয়ে আসি। আমরা বোমাবর্ষণ থামার অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে শিশুটি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।’
ওই দিন বিকেলে নাফ নদের তীরে এসেছিলেন নিসারও। মা, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও বোনকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল তাঁর। নিসার বলেন, ‘মাথার ওপর ড্রোন ওড়ার শব্দ শুনতে পাই। এরপর একটি বিস্ফোরণের শব্দ কানে আসে। তখন আমরা সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তাঁরা ড্রোন দিয়ে আমাদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেছে।’ বোমার আঘাতে নিসার ছাড়া তাঁর পরিবারের সব সদস্য নিহত হন।
ফায়াজ ও তাঁর কন্যারা পালিয়ে নদী পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছেন। তবে মাঝির কাছে অনেক অনুরোধ করেও শিশুটির মরদেহ নৌকায় তুলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এ অবস্থায় মরদেহটি বয়ে বেড়ানোর কোনো অর্থ ছিল না। তাই আমি নদীর তীরেই একটি গর্ত খুঁড়ে তাড়াহুড়া করে মরদেহটি দাফন করে দিই।’ ফায়াজের পরিবার এখন বাংলাদেশে অপেক্ষাকৃত নিরাপদে আছে। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে ধরা পড়লে আবার তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হতে পারে।
নিসার একটি কোরআন বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। এক দিনের ব্যবধানে তাঁর জীবন এভাবে এলোমেলো হয়ে যাবে, তা এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না তিনি। নিসার বলেন, ‘যা ঘটেছে, তা যদি আগে থেকে জানতাম, তাহলে সেদিন আমি কোনোভাবেই বের হওয়ার চেষ্টা করতাম না।’
মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে যা ঘটছে, তার খণ্ডচিত্রগুলো এক ফ্রেমে নিয়ে আসা কঠিন। তবে ৫ আগস্ট বিকেলের ঘটনার একটি চিত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে বিবিসি। হামলা থেকে বেঁচে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা এক ডজনের বেশি রোহিঙ্গার বিশেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছে সংবাদমাধ্যমটি। অনলাইনে রোহিঙ্গাদের শেয়ার করা ভিডিওগুলোও সংগ্রহ করা হয়েছে।
বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সবাই বেসামরিক রোহিঙ্গা মুসলিম। তাদের কারও কাছেই অস্ত্র ছিল না।
ঘটনাস্থলে দুই ঘণ্টা ধরে অনেক বোমা বিস্ফোরণ হতে শুনেছে তারা। বেশির ভাগই বলেছে, বোমাগুলো ড্রোন থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। সম্প্রতি মিয়ানমারে অস্ত্র হিসেবে ড্রোনের ব্যবহার বেড়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, তারা মর্টার ও গুলির আঘাতে আহত হয়েছে।
বাংলাদেশে পরিচালিত এমএসএফ ক্লিনিক জানায়, ৫ আগস্টের পর কয়েক দিনে রোহিঙ্গাদের বড় একটি সংখ্যা আহত অবস্থায় বাংলাদেশে এসেছে। আহত ব্যক্তিদের অর্ধেকই নারী ও শিশু।
এ হামলায় বেঁচে যাওয়া রোহিঙ্গারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু ভিডিও শেয়ার করেছে। এসব ভিডিও যাচাই ও বিশ্লেষণ করেছে বিবিসি। ভিডিওগুলোয় দেখা গেছে, রক্তমাখা মরদেহে ছেয়ে গেছে নাফ নদীর তীর। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। তবে এ হামলায় কতজন নিহত হয়েছে, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী বিবিসিকে জানিয়েছে, তারা বিপুলসংখ্যক মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেছে।
জীবিতরা বিবিসিকে বলেছে, তারা আরাকান আর্মির হামলার শিকার হয়েছে। প্রথমে তাদের গ্রামে হামলা চালিয়ে ঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পরে পালানোর জন্য নদীর তীরে পৌঁছালে সেখানেও হামলা চালানো হয়।
আরাকান আর্মি এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তবে তাঁদের মুখপাত্র খাইং তুখা হামলার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি এক বিবৃতির মাধ্যমে বিবিসির প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলেন, ‘আমাদের নিয়ন্ত্রিত কোনো এলাকায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি। রোহিঙ্গারা হত্যাকাণ্ডের নাটক সাজিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে।’
ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে আরাকান আর্মির এ দাবিকে নাকচ করে দিয়েছেন নিসার। তিনি বলেন, ‘আরাকান আর্মি মিথ্যাচার করছেন। তাঁরাই এ হামলা চালিয়েছেন। ওই দিন তাঁরাই আমাদের এলাকায় ছিলেন। এ ছাড়া কয়েক সপ্তাহ ধরে তাঁরা আমাদের ওপর হামলা চালিয়ে আসছেন। তাঁরা কোনো মুসলিমকে জীবিত রাখতে চান না।’
মিয়ানমার বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমরা সংখ্যালঘু হিসেবে বসবাস করে। দেশটিতে এ দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হাজারো রোহিঙ্গা মুসলিমকে হত্যা করে। তখন জাতিসংঘ এটিকে জাতিগত নিধনের স্পষ্ট উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করেছিল। স্থানীয় রাখাইন পুরুষেরাও ওই হামলায় অংশ নেন।
আরাকান আর্মির প্রতি রাখাইনের জাতিগত জনগোষ্ঠীর ব্যাপক সমর্থন ছিল। বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা সরকারের সঙ্গে আরাকান আর্মির সংঘাত বাড়ছে। এর ফলে আবারও সংকটের মুখে পড়েছে রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারে ফিরে যাওয়া বা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও জীবিত রোহিঙ্গারা বিবিসিকে বলেছে, তারা যে সহিংসতার শিকার হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাতে চায়, যাতে বিষয়গুলো সবার সামনে উঠে আসে। বিশেষ করে এমন একটি এলাকাকে তারা উন্মোচন করতে চায়, যেখানে মানবাধিকার গোষ্ঠী কিংবা সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার নেই।
নিসার বলেন, ‘আমার মন ভেঙে গেছে। এখন আমি সবকিছু হারিয়েছি। আমি জানি না, কেন বেঁচে গেছি।’
রাখাইনে বাড়ির কাছে বোমাবর্ষণ বেড়ে যাওয়ায় নিজের জমি ও বাড়ি বিক্রি করে দেন এক রোহিঙ্গা ধনী ব্যবসায়ী। কিন্তু তাঁর ধারণার চেয়েও দ্রুতগতিতে সংঘাত বেড়ে যায়। এর ফলে ৫ আগস্ট সকালে পরিবার নিয়ে মিয়ানমার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
একটি ভিডিওতে ওই ব্যবসায়ী নিজের মেয়েকে দেখিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মেয়ে আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে আমার হাতের মধ্যেই মারা যায়। তাকে খুব শান্ত দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল সে ঘুমাচ্ছে। সে আমাকে অনেক ভালোবাসত।’
একই ভিডিওতে ওই ব্যবসায়ী তাঁর স্ত্রী ও বোনকে দেখিয়ে বলেন, ভিডিওটি যখন ধারণ করা হয়, তখন তাঁরা মারাত্মক আহত হলেও জীবিত ছিলেন। একের পর এক বোমা পড়তে থাকায় তাঁদের সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেননি ওই ব্যবসায়ী। তাঁদের ফেলে পালিয়ে আসা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। পরে তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী ও বোন মারা গেছেন।
ফায়াজ বলেন, ‘কোনো জায়গাই নিরাপদ ছিল না। ফলে আমরা নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি। গুলি ও বোমা গ্রামের পর গ্রামে তাড়া করে বেড়িয়েছে। তাই কাছে থাকা সব অর্থ এক নৌকার মাঝিকে দিয়ে নদী পার করে দিতে বলি।