জলবায়ু সম্মেলন শেষ হতে চলেছে অথচ পরিবেশের উন্নতিতে অর্থায়নের প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত। দর–কষাকষি এত প্রবল যে ভারতের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী এবং গ্লোবাল এনগেজমেন্ট ডিরেক্টর ফর দ্য ফসিল ফুয়েল নন–প্রোলিফারেশন ট্রিটি ইনিশিয়েটিভ নামে সংগঠনের প্রধান হারজিৎ সিং বলেই ফেললেন, উন্নত দেশগুলোর আচরণে তাঁরা অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছেন। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে ‘কপ২৯’–এর আসরে গত শনিবার প্রথম আলোকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি এই সম্মেলন ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য উন্নত দেশগুলোর অর্থায়নের নানা দিক নিয়ে কথা বলেন। আজাবাইজানের বাকুতে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্মেলন এখন শেষের দিকে। এত দিনের প্রস্তুতি ও চাহিদা মেটার সম্ভাবনা কতখানি?
হারজিৎ সিং: সত্যি বলতে কি, সম্মেলনের অর্ধেক দিন শেষ হয়ে গেল, কিন্তু অর্থায়নের বিষয়টি এখনো থমকে রয়েছে। অথচ এই সম্মেলনে পুরোপুরি অর্থায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করাই ছিল লক্ষ্য। আমরা প্রত্যেকে এতে অত্যন্ত বিচলিত বোধ করছি। এত কিছু সত্ত্বেও উন্নত দেশগুলো এখনো অসম্ভব রকমের উদাসীন। তারা এখনো মনে করে, এটা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জীবন–মৃত্যুর বিষয় নয়, এটা যেন উন্নত দেশের কাছে এক নিরর্থক অর্থ বিনিয়োগ।
কিন্তু উন্নত দেশের সঙ্গে দর–কষাকষিতে আপনারা তো কোনো ঢিলেমি দেননি। নানাভাবে বোঝাতে চেয়েছেন আজকের অর্থায়ন তাদের জন্যও সমান জরুরি।
হারজিৎ সিং: আমাদের সবার দিক থেকে সেই চেষ্টার কসুর তো করা হচ্ছে না। কিন্তু নতুন চাহিদা মেটাতে উন্নত বিশ্ব এখনো কিছুতেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হচ্ছে না। অথচ তারা অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল। অর্থায়নের বিষয়টি অনুদান হিসেবে না দিলে কিংবা ঋণ ও লগ্নি হিসেবে গ্রাহ্য করলে, এই সম্মেলনের সাফল্যই শুধু খর্ব হবে না, সম্পদশালী দেশগুলোর সদিচ্ছা ও সংহতির ওপরও গভীর ছায়া ফেলবে। এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা বোঝায়, তারা শুধু তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কথাই চিন্তা করে। সেটাকেই প্রাধান্য দেয়। এবং সেটা তারা করছে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যারা সতত নিষ্পেষিত হচ্ছে, তাদের স্বার্থের কথা না ভেবে।
এর ফলে এটাই তো দাঁড়াচ্ছে যে, গরিব, অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা যতই গলা ফাটান, সম্মেলন করুন, নিট রেজাল্ট প্রায় শূন্য। এত আয়োজনের তাহলে দরকার কী?
হারজিৎ সিং: দরকার আছে। উন্নত বিশ্বকে চাপ দিতে জলবায়ু আয়োজন চালিয়ে যেতেই হবে। অব্যাহত রাখতে হবে। ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করতে হবে উন্নত বিশ্বের ওপর। তাদের তিষ্টোতে দেওয়া যাবে না। জলবায়ুর স্বার্থে আজ যেটুকু হয়েছে, তা হয়েছে এই চাপ সৃষ্টির জন্যই।
কিন্তু সেখানেই তো সব আটকে রয়েছে। তাহলে কি হতাশাতেই কাটবে, নাকি কিছুটা আশান্বিত হয়ে আমরা সবাই ঘরে ফিরব?
হারজিৎ সিং: আশা হারানো যাবে না। এখনো আমি ও আমরা সবাই আশা করছি, অর্থায়নের নতুন একটা বলিষ্ঠ ও আশাব্যঞ্জক লক্ষ্য স্থাপন করা সম্ভব হবে। সেটা বিলিয়ন ডলারের হিসাবে নয়, ট্রিলিয়নের হিসাবে হবে। আমাদের প্রয়োজন মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। কার্বন প্রশমন ও অভিযোজন দুই ক্ষেত্রেই।
আশা করা অন্যায় নয়। কিন্তু ঘটনা হলো, এত কিছুর পরেও, এত সচেতনা বৃদ্ধি সত্ত্বেও তাপমান বেড়ে চলেছে। মানুষ আরও বেশি করে বিপন্ন হচ্ছে।
হারজিৎ সিং: সেটা অবশ্যই সত্যি। কিন্তু পাশাপাশি এটাও ঠিক, সে জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না। আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে তুলতে হবে। এখান থেকেই আমাদের আরও কয়েক কদম এগিয়ে যেতে হবে। যদি তা না হয়, যদি ব্যর্থতা আসে, তাহলে কপ২৯–ই শুধু ব্যর্থ হবে না, আমরা আমাদের এই গ্রহকেও ব্যর্থ করে তুলব।
একটা বিষয় খুবই চর্চায় চলে এসেছে। পরপর দুটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো এমন দুই দেশে, যারা তেল ও গ্যাসের ওপর ভাসমান। জীবাশ্ম জ্বালানি যাদের অর্থনৈতিক রমরমার কারণ। এবং কেউই তা কমানোর পক্ষে নয়। এটা কি পরিহাসের নয়?
হারজিৎ সিং: এটা অনস্বীকার্য যে ওই সিদ্ধান্ত আপাত বৈপরীত্যের শামিল। পরপর দুটি সম্মেলন দুই পেট্রোস্টেটে করা হলো। বিশেষ করে কার্বন নিঃসরণ যখন বেড়ে চলেছে। তবে হ্যাঁ, আমরা দেখেছি সংযুক্ত আরব আমিরাত একটা উচ্চাভিলাষী জাতীয় অ্যাকশন প্ল্যান, জলবায়ু পরিভাষায় যাকে ‘ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কন্ট্রিবিউশনস’ বা এনডিসি বলা হচ্ছে, তা জমা দিয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা এটাও দেখতে চাই, সব পেট্রোস্টেট এমন ইতিবাচক সাড়া দিচ্ছে। শুধু দেশে নির্গমনের মাত্রা কমানোই সব নয়, তাদের পেট্রো ব্যবসার মডেলও পাল্টাতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানির বদলে নবায়নযোগ্য গ্রিন এনার্জির দিকে ঝুঁকতে হবে। এটাই ক্ষতিগ্রস্ত দুনিয়ার দাবি। আমাদের প্রত্যেকেরই সমস্যার গভীরে যেতে হবে।
সেই চেষ্টাই তো চলছে। কিন্তু সাফল্য আসছে কই?
হারজিৎ সিং: দুঃখের বিষয় এটাই যে, কপ২৮–এ যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেগুলো রূপায়ণের ক্ষেত্রে ‘কপ২৯’ হিমশিম খাচ্ছে। এটা মোটেই ভালো ইঙ্গিত নয়।
এই হতাশার বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে উঠেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প!
হারজিৎ সিং: অবশ্যই। ট্রাম্পের জয় এই পৃথিবীর কাছে এক বিরাট ধাক্কা। কিন্তু যেটা বাস্তব সেটা মেনে নিয়েই চলতে হবে। তবে এটাও বুঝতে হবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভরসা করা চলবে না। আমরা আশা করব, কয়েক বছর ধরে যারা যুক্তরাষ্ট্রে নির্মল শক্তিতে (ক্লিন এনার্জি) বিনিয়োগ করেছে, কিছুটা অগ্রগতিও হয়েছে, তারা সেখান থেকে পিছিয়ে আসবে না। পাশাপাশি অন্যান্য উন্নত দেশেরও ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র বিচ্ছিন্নভাবে বাঁচতে পারবে না। অন্যদের সঙ্গে তাকে ব্যবসা–বাণিজ্য করতে হবে। ফলে তাদেরও চাপ দিতে হবে।
অন্যরা কি তা করবে?
হারজিৎ সিং: করা উচিত। অবশ্যই করা উচিত।
উচিত তো অবশ্যই, কিন্তু সেই চাপ তারা দেবে কি?
হারজিৎ সিং: মানুষই চাপ দিতে বাধ্য করবে। সে জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। গণমাধ্যমকে এমন ভূমিকা পালন করতে হবে, যাতে মানুষ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। বাধ্য করে ন্যায্য চাহিদার প্রতি সম্মান দেখাতে।
দেখা যাক ‘কপ২৯’ তার লক্ষ্যে কতটা পৌঁছতে পারল।
হারজিৎ সিং: আমাদের সেই আশাতেই থাকতে হবে। সাফল্য না ব্যর্থতা কোন দিকে পাল্লা ঝোঁকে, আর কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে।