উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়াকে তাঁর দেশের ‘প্রধান শত্রু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। শুধু তা–ই নয়, দক্ষিণ কোরিয়াকে যুদ্ধের হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
কিমের এসব বক্তব্য কি আসলেই দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধের বার্তা দিচ্ছে? বার্তা সংস্থা এএফপি এ–সংক্রান্ত একটি বিশ্লেষণ প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কয়েক বছর ধরে সম্পর্কের টানাপোড়েন চলার মধ্যে সম্প্রতি পিয়ং ইয়ং আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, সিউল তাদের প্রধান শত্রু। দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণের লক্ষ্যে গঠিত সংস্থাগুলো বিলোপ করে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে দক্ষিণ কোরিয়া দখল করে নেওয়ারও হুমকি দিয়েছে উত্তর কোরিয়া।
সিউলভিত্তিক কোরিয়া ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল ইউনিফিকেশনের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক হং মিন বলেন, ‘এটি একটি বড় পরিবর্তন। কারণ, অতীতে সশস্ত্র সংঘাতের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য একটি অনানুষ্ঠানিক মাধ্যম ছিল। কিন্তু এখন এর কিছুই নেই।’
হংয়ের ধারণা, দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘প্রধান শত্রু’ হিসেবে আখ্যা দেওয়াটা উত্তর কোরিয়ার জন্য কথার কথা নয়। এ কথাকেই ‘কার্যে পরিণত করা হতে পারে।’
কিম কি উত্তর কোরিয়ায় আক্রমণ করবেন?
কিম বলেছেন, যুদ্ধ শুরু করার কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই। তবে তা এড়ানোরও কিছু নেই।
কিম ইতিমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি এখন আর উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যকার সমুদ্রসীমার স্বীকৃতি দেবেন না। এ সমুদ্রসীমা নর্দার্ন লিমিট লাইন হিসেবে পরিচিত। ওই এলাকায় উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী সম্প্রতি তাজা গোলার মহড়া চালিয়েছে।
হং মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে দুই পক্ষের সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে, আর তা পরবর্তী সময়ে বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
তার ওপর পিয়ংইয়ং ক্রমাগত মস্কোর দিকে ঘেঁষছে। ওয়াশিংটন ও সিউলের দাবি, ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিচালনায় রাশিয়ার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র পাঠাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। এর বিনিময়ে রাশিয়া উত্তর কোরিয়াকে স্যাটেলাইট কর্মসূচি চালাতে সহযোগিতা করছে।
অপর দিকে যেকোনো উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের জবাব দেওয়া হবে বলে কয়েকবারই কঠোর ভাষায় হুঁশিয়ার করেছে সিউল।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়াভিত্তিক সংবাদপত্র হ্যানকিয়োরেহের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, ‘আন্তকোরীয় সংলাপের ক্ষেত্রে কঠোর আচরণ করাটা উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া—কারও জন্যই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। উত্তর কোরিয়া যেহেতু আরও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে, আমরা আশা করি, সরকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব (আলোচনায়) দেবে।’
সাংজি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামরিক অধ্যয়নবিষয়ক অধ্যাপক চোই জি ইল মনে করেন, দুই কোরিয়ারই এখন সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার প্রবল আশঙ্কা আছে।
২০১০ সালে উত্তর কোরিয়া যখন দক্ষিণ কোরিয়ার দুর্গম সীমান্ত দ্বীপ ইয়েওনপিয়ংয়ে হামলা চালায় এবং চারজন নিহত হন, তখন পাল্টা হামলা চালাতে সিউলের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান প্রস্তুত ছিল। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লি মিয়ুং বাক তা হতে দেননি। উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এড়াতে তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
চোই বলেছেন, আবার যদি দক্ষিণ কোরিয়া একই ধরনের ঘটনার সম্মুখীন হয়, তখন যে সিউল তাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ব্যবহার করবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এরপর যদি পিয়ং ইয়ং পাল্টা হামলা চালায়, তবে কোরীয় উপদ্বীপে পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ-এর সাবেক বিশ্লেষক সু কিম এএফপিকে বলেন, আন্তকোরীয় পুনরেকত্রীকরণের সম্ভাবনা দীর্ঘদিন আগেই ফিকে হয়ে গেছে। আর এখন কিম সরাসরিই সিউলকে তাদের ১ নম্বর শত্রু ঘোষণা করেছেন। তিনি শুধু সৌহার্দ্যের দরজা বন্ধই করেননি, সেখানে তালাও লাগিয়েছেন। আর এর মধ্য দিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরীয়দের বুঝিয়ে দিয়েছেন দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে তাঁর অবস্থান কী।
সু কিম বলেন, এসব নতুন বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘উত্তর কোরিয়াকে যে তাদের হিসাব নিকাশে’ পরিবর্তন আনতে হয়েছে, তা নয়।
দীর্ঘদিন ধরে পিয়ং ইয়ং পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে। বহুল প্রতীক্ষিত সপ্তম পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন কিম।
সু কিম বলেন, ‘এসব অস্ত্র রাতারাতি তৈরি হয়নি। কিম সরকার কয়েক দশক ধরেই এগুলোকে বলপ্রয়োগ, হুমকি ও দর-কষাকষির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা করে রেখেছে।’
সিউলভিত্তিক ইওয়াহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক লিফ এরিক ইয়াসলি বলেছেন, দক্ষিণ কোরিয়াকে নিয়ে কিমের দেওয়া নতুন বার্তাকে তাঁর সরকারের মতাদর্শ টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে কিম তাঁর পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ন্যায্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন। কারণ, উত্তর কোরিয়ার নাগরিকেরা এখন দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য নিয়ে যতটা না চিন্তিত তার চেয়ে বেশি চিন্তিত নিজ দেশের অর্থনৈতিক অবনতি নিয়ে।
আগামী এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইউলের দল আবারও ক্ষমতায় ফেরার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।
ইয়াসলি মনে করেন, এপ্রিলের নির্বাচনকে সামনে রেখে উত্তর কোরিয়া ইউনের প্রশাসনকে রাজনৈতিকভাবে শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। পিয়ংইয়ংয়ের প্রতি ইউন প্রশাসন যে নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে, তার জন্য এ শাস্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে।