মিয়ানমারের জান্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের অভিযোগ

রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিত্তেতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এক সদস্য
ফাইল ছবি: এএফপি

মিয়ানমারের জান্তা সরকার যুদ্ধবিরতি চুক্তি বারবার ভঙ্গ করছে বলে অভিযোগ তুলেছে দেশটির জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। জোটের সদস্যেদর দাবি, চীনের মধ্যস্থতায় যুদ্ধিবরতি চুক্তি সত্ত্বেও সামরিক বাহিনী (জান্তা) চলতি মাসে দেশটির উত্তরাঞ্চলে বারবার হামলা চালিয়েছে। এতে অনেক বেসামরিক মানুষ হতাহত হয়েছে।

থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের সদস্য তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) জোটের টেলিগ্রাম চ্যানেলে এক বিবৃতি পোস্ট করে। সেখানে বলা হয়, বুধবার টিএনএলএর নিয়ন্ত্রণাধীন মোগক শহরে বিমান হামলা চালিয়েছে জান্তা সেনারা। এ ঘটনায় একজন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে ১০ বছরের এক শিশুসহ তিনজন।

এর আগে গত মঙ্গলবার সামরিক বাহিনীর ড্রোন হামলায় টিএনএলএর এক সদস্য নিহত এবং চারজন আহত হন বলেও দাবি করে গোষ্ঠীটির। তাদের ভাষ্য, এ ছাড়া তাদের ঘাঁটিগুলোতে গোলা নিক্ষেপ করেছে এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। ফলে গোষ্ঠীটির নিয়ন্ত্রিত শহরগুলোয় পণ্য সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এসব হামলা ছিল জান্তা সামরিক বাহিনীর চালানো সাম্প্রতিক সময় যুদ্ধবিরতি চুক্তি লঙ্ঘনের ঘটনা।

২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সু চির নির্বাচিত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ক্ষমতা দখলের পরপরই মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়। গণবিক্ষোভ দমনে সামরিক শক্তি ব্যবহার করে জান্তা সরকার। এর জেরে মিয়ানমারে জান্তা সরকারবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। একপর্যায়ে দেশটির জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো একটি জোট গঠন করেছে। থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স নামের এই জোটে আছে আরাকান আর্মি (এএ), মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মি (এমএনডিএএ) ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ)।

২০২৩ সালের অক্টোবরে এই জোট সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান শুরু করে। মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলে আচমকা অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকটি শহর ও চীনের সীমান্তবর্তী কিছু বাণিজ্যিক কেন্দ্রও হস্তগত করে তারা। জান্তা সরকারকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু ও কোণঠাসা করে দেওয়ার লক্ষ্যেই মূলত তারা এ হামলা চালায়।

এ জোটের সঙ্গে সামরিক জান্তার মাসের পর মাস ধরে চলা সহিংসতায় ৫ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এ সংকট নিরসনের লক্ষ্যে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীনের মধ্যস্থতায় সামরিক জান্তা ও থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর হয়। চুক্তির ফলে জোটটি মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলের শান প্রদেশে দখলকৃত ভূখণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার অনুমতি পায়।

এদিকে শান প্রদেশে সংঘাত কিছুটা কমে আসার পর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে রাখাইন। পশ্চিমাঞ্চলের এ রাজ্যে সহিংস হয়ে ওঠে আরাকান আর্মি (এএ)। তাদের ভাষ্য, রাখাইন জনগোষ্ঠীর আরও বেশি স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে এ লড়াই। এরই মধ্যে তারা রাখাইনে ভারত ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

চীন গত মাসে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যকার যুদ্ধবিরতি চুক্তির ধারাবাহিকতায় কুনিমিং শহরে একটি শান্তি আলোচনার আয়োজন করে। এমএনডিএএর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র এএফপিকে জানায়, এ সংলাপে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংকট নিরসনে ভবিষ্যতে উভয় পক্ষ আবার আলোচনায় বসবে।

এদিকে দেশটির চলমান এই অস্থিরতা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে বাণিজ্য খাতে। বিশেষ করে ধস নেমেছে সীমান্ত বাণিজ্যে। জান্তা–নিয়ন্ত্রিত একটি সংবাদমাধ্যম গত সপ্তাহে জানায়, চলতি বছরের এপ্রিল-মে মাসে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্ত বাণিজ্য গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় তিন গুণ কমেছে।

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেই মূলত জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর বেশির ভাগের বসবাস। ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের কাছে থেকে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই স্বায়ত্তশাসন ও সম্পদের ওপর নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সামরিক জান্তার সঙ্গে লড়াই করছে এসব বিদ্রোহী গোষ্ঠী।