সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে জন্ম নেওয়া সেই শিশুটি যেমন আছে

ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্ম নেওয়া শিশুটিকে উদ্ধার করে শুরুতে সিরিয়ার আফরিন শহরের একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ছবি: এএফপি

সিরিয়ায় ভয়াবহ ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্ম নেওয়া ফুটফুটে মেয়েশিশু আফরার বয়স এখন ৪০ দিন। সে সুস্থ আছে। ভূমিকম্পে ধসে পড়া বাড়ির ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েন তার অন্তঃসত্ত্বা মা। আর সেখানেই জন্ম হয় আফরার। নবজাতকের জন্মের পরপরই মারা যান ওই নারী। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় শিশুটি। তবে শুধু মাকে নয়, এই পৃথিবীতে আসার দিনই ভূমিকম্পে বাবা এবং ভাইবোনকেও হারিয়েছে শিশুটি। এ কারণে শিশুটিকে ‘অলৌকিক শিশু’ বলা হয়।

আফরার পরিবারের সব সদস্যের মৃত্যু হওয়ায় এতিম হয়ে পড়ে সে। বর্তমানে তাকে তার চাচি ৩১ বছর বয়সী হালা লালনপালন করছেন। হালাদের বাড়িও ভূমিকম্পে বিধস্ত হয়ে গেছে। তিনি এখন স্বামী, সন্তান ও আফরাকে নিয়ে একটি ছোট্ট ক্যাম্পে দিন কাটাচ্ছেন।

আফরার চাচাতো ভাইবোন ছয়জন। সবচেয়ে বড়জন ১০ বছর বয়সী মাল আল–শাম। আর সবচেয়ে ছোটজনের বয়স সবে এক মাস পেরিয়েছে, নাম আতা। আফরার জন্মের দুই দিন পর তার জন্ম।

৪০ দিন বয়সী আফরা তার চাচার কোলে।

আফরার চাচা ও হালার স্বামী ৩৪ বছর বয়সী খলিল শামি আল–সুওয়াদি গত ৬ ফেব্রুয়ারি ভূমিকম্পের সময় জেগেই ছিলেন। তাঁর সঙ্গে দুই সন্তানও জেগে ছিল। ওই রাত তাঁদের জন্য ছিল খুব উদ্বেগের।

খলিলের শ্যালক ২৬ বছর বয়সী আবদুল্লাহ রাতের খাবারের জন্য তাঁদের বাসায় এসেছিলেন। খাওয়া শেষে তিনি বোনের বাসায় রাতে থেকে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁদের বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় সহজেই একে অন্যের বাড়িতে থাকতে পারেন।

আফরার পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্ম নেওয়ায় তার ফুসফুসে ধুলা ঢুকেছিল।

আবদুল্লাহ আবু রুদায়না নামেও পরিচিত। তাঁর বড় মেয়ের নাম রুদায়না। রাতে খাওয়ার পরে তিনি বোন হালা ও খলিলকে জানিয়েছিলেন, তিনি একটু পর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করে বাড়িতে ফিরে যাবেন। পরে রাত দুইটার দিকে তিনি অনলাইন স্ট্যাটাস পরিবর্তন করে লিখেছিলেন, ‘আপনার মৃত্যু এমনকি আপনার বাড়িতেও আসতে পারে।’

খলিল বলেন, ভূমিকম্প প্রথম যখন আঘাত হানে, তখন তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে পাশের বাড়িতে তাঁর চাচাতো ভাইয়ের পরিবার বিপদে পড়েছে। বাইরে বের হয়ে দেখেন, ঘটনা সত্য। ইতিমধ্যে খনন শুরু হয়েছে। প্রথমে হাত দিয়ে তারপর তাঁর ইদলিবের এক বন্ধুর ধার দেওয়া সরঞ্জাম দিয়ে উদ্ধারকাজ চালানো হয়। একপর্যায়ে একজন তাঁকে বলেন যে এক নারীর শরীরের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। ওই নারী ছিলেন তাঁর চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী উম্মে রুদায়না। এরপর খননকাজ আরও বাড়ানো হয়।
খলিল ধ্বংসস্তূপের নিচে শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। এ সময় তিনি আশা করেছিলেন, তাঁর চাচাতো ভাই বেঁচে আছেন। কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে আসা শব্দগুলো একটি শিশুর। দ্রুত ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে দেখা যায়, একটি শিশু উম্মে রুদায়নার শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে। এটাই আফরা। পরে কেউ একজন ছুরি নিয়ে নাভি কাটার জন্য ছুটে যান।

চাচার কোলে আফরা (গোলাপি টুপি) ও আতা। পাশে চাচাতো ভাই শামি এবং বোন মরিয়ন ও দোআ।

খলিল বলেন, ‘তখনো আমি জানতাম, পরিবারের বাকি সদস্য সবাই মারা গেছে। আর কিছু না ভেবে শিশুটিকে নিয়ে জান্দারিসের সামরিক হাসপাতালে যাই, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। আমার স্ত্রী সে সময় অন্তঃসত্ত্বা। এর দুই দিন পর তাঁর প্রসবব্যথা ওঠে। আমি সঙ্গে থাকতে পারিনি। এ কারণে আমাদের কুর্দি প্রতিবেশী উম্মে আবদু তাঁর সঙ্গে ছিলেন। সামরিক হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছিল, শিশুটি ভালো আছে। তাকে যেকোনোভাবে বুকের দুধ খাওয়ানো দরকার। হাসপাতালে একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে আফরা কয়েক দিন ছিল।’

হালা বলেন, ‘আফরার পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙে গিয়েছিল। ধ্বংসস্তূপের নিচে জন্ম নেওয়ায় তার ফুসফুসে ধুলা ঢুকেছিল। আমরা তাকে নিয়মিত চেকআপের জন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। আমি দুই মেয়েকেই বুকের দুধ খাওয়াচ্ছি...আমি কখনোই আফরাকে ছেড়ে যাব না। সে আমার ভাতিজি, আমার নিজের রক্ত তার শরীরে। অনেক মানুষ তাকে দত্তক নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমরা দিইনি। আমার নিজের সন্তানের মতোই তার দেখভাল করব।’

নিজের সন্তানের মতোই আফরার দেখভাল করছেন তার চাচা–চাচি।

খলিল বলেন, ‘আমি আমার চাচাতো ভাইকে ভালোবাসতাম, সবাই বাসে। তাঁর মেয়ের যত্ন নিজের মেয়ের মতো করেই নেব। তার বাবার পরিবার আফরাকে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, দত্তক নিতে চেয়েছিল, কিন্তু আমি রাজি হইনি। আমি তার দাদা-দাদির সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা রাজি হয়েছেন, আফরাসহ আমাদের আশীর্বাদ দিয়েছেন।’

খলিল ও হালার আট বছর বয়সী সন্তান দোআ বলেছে, ‘আফরাকে যখন মা–বাবা আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে, তখন আমি খুব খুশি হয়েছি। সে আমার চাচাতো বোন।’
অন্য চাচাতো ভাইবোনদের জন্য মন খারাপ হয় দোআর। কারণ, আফরার জন্মের দিন তার ভাইবোন রাদুনা, আত্তাওয়া, নাওয়ারা ও হামুদির মৃত্যু হয়। দোআ বলেছে, ‘এখন যদি আমাকে প্রিয় কোনো শিশুকে বেছে নিতে হয়, তবে আমি আফরাকে বেছে নেব। কারণ, সে আমার চাচা আবদুল্লাহ ও তাঁর পরিবারের স্মৃতিচিহ্ন।’

গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী এই ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে বিস্তীর্ণ জনপদ। সরকারি হিসাবে তুরস্কে প্রায় ৪৬ হাজার এবং সিরিয়ায় ৬ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। ভূমিকম্পে অন্তত ১৫ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়েছে।