ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারে চলছে তল্লাশি। দিয়ারবাকির, তুরস্ক
ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়াদের উদ্ধারে চলছে তল্লাশি। দিয়ারবাকির, তুরস্ক

ভূমিকম্পে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়, দ্রুত বাড়ছে মৃতের সংখ্যা

ভোরে সবাই যখন গভীর ঘুমে তখন শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক ও সিরিয়াসহ আশপাশের দেশগুলো। ভয়াবহ এই ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে ২ হাজার ৩১৯ জন এবং সিরিয়ায় প্রায় ১ হাজার ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। ধসে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেকে আটকা পড়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় তুরস্ক জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। দেশটি ৮৪ বছরের মধ্যে এত শক্তিশালী ভূমিকম্প দেখেনি।

মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা জানায়, স্থানীয় সময় আজ সোমবার ভোররাত ৪টা ১৭ মিনিটে ভূমিকম্পটি আঘাত হানে। এর উৎপত্তিস্থল ছিল সিরিয়া সীমান্তবর্তী তুরস্কের গাজিয়ানতেপ শহরের কাছে। ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮।

সংস্থাটি আরও জানায়, তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারাসহ দেশটির অন্যান্য শহরে এবং পার্শ্ববর্তী সিরিয়াসহ প্রতিবেশী দেশ লেবানন, সাইপ্রাস, ইসরায়েলেও এই ভূকম্পন অনুভূত হয়। এরপর কয়েকবার পরাঘাত আঘাত হানে। এগুলোর মধ্যে একটি ছিল ৬ দশমিক ৪ ও একটি ৬ দশমিক ৫ মাত্রার।

একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয় শিশুটিকে। দিয়ারবাকির, তুরস্ক

আল-জাজিরার খবরে বলা হয়, তুরস্কে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হলো কাহরামানমারাস, গাজিয়ানতেপ, সানলিউরফা, দিয়ারবাকির, আদানা, আদিয়ামান, মালত্য, ওসমানিয়ে, হাতায় ও  কিলিস। আর সিরিয়ার আলেপ্পো, ইদলিব, হামা ও লাতাকিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভূমিকম্পে দুই দেশের কয়েক হাজার ভবন ধসে পড়েছে। ঘটনার পরপরই অনুসন্ধানকারী ও উদ্ধারকারী দল কাজ শুরু করে। তবে তুরস্কে শীতকালীন তুষারঝড়ের কারণে উদ্ধারকাজ ব্যাহত হচ্ছে। তুষারে অনেক সড়ক ঢেকে গেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ভূমিকম্পে হতাহতদের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি এই বিপর্যয় মোকাবিলায় জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন।

দ্বিতীয় ভূমিকম্প

ভূমিকম্পে কাহরামানমারাস ধসে পড়া বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপ, তুরস্ক

প্রথম ভূমিকম্পের কয়েক ঘণ্টা পর গাজিয়ানতেপ থেকে প্রায় ৮০ মাইল দূরে তুরস্কের কাহরামানমারস প্রদেশের ইলবিস্তান জেলায় আরও একটি শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। এর মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৫। তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি কোনো পরাঘাত নয়। এটা নতুন ভূমিকম্প। প্রথম ভূমিকম্পের পর এই প্রদেশে এখন পর্যন্ত ৭০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তবে দ্বিতীয় ভূমিকম্পের কারণে হতাহতের বিষয়ে জানা যায়নি।

চোখের সামনে জানালাগুলো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়

এ ঘটনায় বেঁচে যাওয়া তুরস্কের মালত্য শহরে ২৫ বছর বয়সী ওজগুল কনাকচি বলেন, ভূমিকম্পের সময় তিনি ও তাঁর ভাই ঘুমাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলি, তুমি কি কাঁপছ? আমি ল্যাম্পের (বাতি) দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল ল্যাম্পটি ভেঙে যাচ্ছে। আমরা আমাদের তিন বছর বয়সী ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।’ ওজগুল কনাকচি বলেন, সব লোক এখন রাস্তায় অবস্থান করছেন। তাঁরা কী করবেন, তা নিয়ে বিভ্রান্ত।

ধসে পড়ছে একটি ভবন। হালিলিয়া জেলা, সানলিউরফা প্রদেশ, তুরস্ক

ভূমিকম্পে ওজগুলদের ভবনটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁদের আশপাশের পাঁচটি ভবন ধসে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের চোখের সামনে পরাঘাতে একটি ভবনের জানালাগুলো ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।’

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় আদানা শহরের বাসিন্দা নিলুফার আসলান একটি পাঁচতলা বাড়িতে থাকতেন। ভূমিকম্পের সময় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন আর বাঁচবেন না। আর তা ভেবে আশপাশের কক্ষে থাকা পরিবারগুলোর সবাইকে ডাকতে থাকেন তিনি। বলেন, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে। চল, অন্তত সবাই এক জায়গায় একসঙ্গে মরি।’ ভূমিকম্পের সময় এক মিনিট ধরে তাঁরা দুলেছেন। ভূমিকম্প থামার পর বাইরে বের হয়ে দেখতে পান, তাঁর বাড়ির আশপাশের চারটি ভবন ধসে পড়েছে।

তুরস্কের আরেক শহর গাজিয়ানতেপের বাসিন্দা এরদেম বলেন, ভূমিকম্পের সময় চারপাশ দুলছিল। দোলনায় দোলার মতো অনুভূতি হচ্ছিল। রয়টার্সকে ফোনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এরদেম বলেন, ৪০ বছরের জীবনে এমন ঘটনা দেখেননি। তিনি আরও বলেন, আতঙ্কে সবাই হয়তো তাঁদের গাড়িতে বসে আছেন, অথবা নিজ নিজ ভবন থেকে বাইরে খোলা জায়গায় চলে যান। ‘আমার মনে হয় গাজিয়ানটেপের একজন বাসিন্দাও এখন আর বাড়িতে নেই,’ বলেন এরদেম।

ভূমিকম্পের সময় কেঁপে ওঠে অ্যাকুরিয়ামের পানি

এদিকে সিরিয়ার ইদলিব শহরের বাসিন্দা আল্লা নাফি এই ভূমিকম্পকে ভয়ংকর হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘মাঝরাতে পুরো ভবন কেঁপে ওঠে। তখন কোথায় পালাব, তা বুঝতে পারছিলাম না।’ এক ভিডিওতে দেখা গেছে, সিরিয়ার আলোপ্পো শহরে ভবনগুলো ধসে পড়ে ধুলার কুণ্ডলী তৈরি হচ্ছে আর লোকজন আতঙ্কে চিৎকার করে পালানোর চেষ্টা করছে।

বৃষ্টি ও তুষারপাতের আশঙ্কা

বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে মানুষ। আলেপ্পো, সিরিয়া

তুরস্কে প্রথম ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলের অঞ্চলে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দিনের তাপমাত্রা ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসবে আর রাতে তা হিমাঙ্কের নিচে থাকবে। প্রায় ৩-৫ সেন্টিমিটার পুরু তুষারপাত হতে পারে। আর উত্তরে ভারী তুষারপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আরও পার্বত্য অঞ্চলে আগামী দিনগুলোর তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ওপরে উঠবে না বলে মনে করা হচ্ছে। যার অর্থ ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার তুষারপাত হতে পারে।

প্রথম ভূমিকম্পে তুরস্কে অন্তত ২ হাজার ৮০০ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মানে হাজারো মানুষ এখন খোলা আকাশের নিচে। তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকাতে বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব আমরা দুর্গতদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করছি। প্রচণ্ড ঠান্ডা, অনেক মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছে, তারা খোলা জায়গায় আছে। ইতিমধ্যে সিরিয়ার উত্তরাংশে লাখ লাখ মানুষ তাঁবুতে ঠাঁই নিয়েছে।’

৮৪ বছর পর তুরস্কে এমন ভয়াবহ ভূমিকম্প

আহত একজনকে নেওয়া হচ্ছে হাসপাতালে। আদিয়ামান, তুরস্ক

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ভূকম্পনবিদ স্টিফেন হিকস বলেন, ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বরে তুরস্কের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই সময় ৩০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। এ ঘটনার পর ১৯৯৯ সালে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্প ইস্তাম্বুলের দক্ষিণে তুরস্কের মারামারা অঞ্চলে আঘাত হানে। এতে সাড়ে ১৭ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিল।  

১০ শহর ও প্রদেশের স্কুল এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ

এক শিশুকে উদ্ধার করে ছুটছেন উদ্ধারকর্মী। জান্দারিস, সিরিয়া

তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতায় বলেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্কের ১০টি শহর ও প্রদেশের স্কুলগুলো এক সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শহর ও প্রদেশগুলে হলো কাহরামানমারাশ, হাতায়, গাজিয়ানতেপ, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালত্য, শানলিউরফা, আদানা, দিয়ারবাকির ও কিলিস।

তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের আদানা বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছ বেসরকারি বার্তা সংস্থা দেমিরোরেন। এ ছাড়া মারাস ও আন্তেপের বিমানবন্দরগুলোতে বেসামরিক ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

স্রোতের মতো রোগী আসছে

ধ্বংসস্তূপের নিচে জীবিত কেউ আছেন কি না, সেই খোঁজ চলছে। সালেহেদ্দিন, আলেপ্পো, সিরিয়া

সিরিয়ার জাতীয় ভূকম্পন কেন্দ্রের প্রধান রায়েদ আহমেদ রাষ্ট্রীয় বেতার স্টেশনকে বলেন, ‘আমাদের এই কেন্দ্রের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প।’ ১৯৯৫ সালে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

আলেপ্পোর স্বাস্থ্য পরিচালক জিয়াদ হেগ তাহা রয়টার্সকে বলেন, ঢেউয়ের মতো আহত মানুষ হাসপাতালে আসছে। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা যায়, উদ্ধারকারী দলগুলো ভারী বৃষ্টি ও তুষারপাতের মধ্যে বেঁচে থাকা মানুষদের খুঁজছে।
বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা সীমান্তবর্তী শহর আজাজে দেখা গেছে, ধসে পড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে এক শিশুকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আরেকটি গ্রুপকে দেখা গেছে, একটি ক্রেনে কংক্রিটের স্ল্যাব টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় সাদা চাদরে মোড়ানো একটি লাশও নেওয়া হচ্ছে।

দিয়ারবাকিরের ৩০ বছর বয়সী এক বাসিন্দা বলেন, ‘ভূমিকম্পের সময় তীব্র শব্দে আমাদের আশপাশের ভবনগুলো ধসে পড়ে। আমি দৌড়ে বাইরে আসি। চারপাশে শুধু চিৎকার। আমি হাত দিয়ে পাথর সরাতে শুরু করলাম। এরপর বন্ধুদের নিয়ে আহত ব্যক্তিদের বের করতে শুরু করলাম। কিন্তু চিৎকার থামেনি। তারপর উদ্ধারকারী দলগুলো আসে।’

বিশ্বনেতাদের পাশে থাকার আশ্বাস

আদানায় স্বজনদের খোঁজে বেঁচে যাওয়াদের আহাজারি

তুরস্কে জরুরি সহায়তা দিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এরই মধ্যে ১০টি অনুসন্ধান ও তল্লাশি দল পাঠিয়েছে। বুলগেরিয়া, ক্রোয়েশিয়া, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, গ্রিস ও নেদারল্যান্ডস, পোল্যান্ড ও রোমানিয়া থেকে প্রাথমিক উদ্ধারকাজে এই দলগুলোকে পাঠানো হয়। ইতালি ও হাঙ্গেরিও সহায়তা করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রাশিয়া, কাতার, ইউক্রেন, ভারত, চীনও সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত তুরস্ক ও সিরিয়াকে কীভাবে সহায়তা করা যায়, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশনা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

সূত্র: বিবিসি, আল-জাজিরা, এএফপি, রয়টার্স