মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই-সংঘাত চলছে। এই সংঘাত রাজ্যের রোহিঙ্গা ও রাখাইন তরুণদের শিক্ষা ও কাজ করার স্বপ্নকে ক্রমেই ফিকে করে ফেলছে। তাঁরা জীবন বাঁচাতে কিংবা লড়াইয়ে যোগ দেওয়া এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এমনই একজন রাজ্যের সংখ্যাগুরু রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর থুরা মাআং। ১৮ বছরের এই তরুণ রাখাইন রাজ্যের উপকূলীয় শহর মায়বনে থাকেন। সেখানে গত বছরের নভেম্বর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং স্বাধীনতাকামী আরাকান আর্মির সঙ্গে তীব্র লড়াই শুরু হয়। পরের মাসেই প্রথম বাড়িঘর ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে নদী পার হয়ে পালিয়ে যান থুরা মাআং। কয়েক দিন পর তাঁরা ফিরেও আসেন। কিন্তু পরের কয়েক মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বাড়লে থুরার পরিবার আরও দুবার শহরের বাড়িঘর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে যায়।
যুদ্ধের কারণে মাআং যে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতেন, সেটি বন্ধ হয়ে গেছে। পড়াশোনা নিয়ে হতাশ এই তরুণ বলেন, ‘নিজের জীবনকে উন্নত করার কোনো সুযোগ সেখানে নেই এবং আমি কোনো ভবিষ্যৎও দেখতে পাচ্ছি না।’
একই অবস্থা আরেক তরুণ জুবায়েরের। রাজ্যের সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমান জাতিগোষ্ঠীর এই তরুণের বাড়ি মাআংদাউ শহরতলিতে। ২৪ বছরের এই তরুণ সংঘাত শুরুর আগে রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করা একটি নাগরিক সংগঠনে চাকরি করতেন। সংঘাত শুরু হলে তাঁদের অফিস বন্ধ হয়ে যায়।
মিয়ানমার সেনাবাহিনী জোর করে রোহিঙ্গা তরুণদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ শুরু করলে সেটা এড়াতে জুলাইয়ে নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে যান জুবায়ের। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘আমরা বাড়িতে থাকতে পারছি না, কাজে যেতে পারছি না, এমনকি সময়মতো ঘুমাতেও পারছি না। যে সময়ে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ার কথা ছিল, সে সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’
জুবায়ের ও থুরা মাআং মিয়ানমারের নতুন প্রজন্মের তরুণদের প্রতিচ্ছবি, দেশটিতে ২০২১ সালের সেনা অভ্যুত্থানের পর যাঁদের জীবন পুরো উল্টে গেছে। ২০১৭ সালে ভয়াবহ জাতিগত দাঙ্গার পর থেকেই রাখাইন রাজ্য অশান্ত। অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে লড়াইয়ের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে সেখানকার পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।
যুদ্ধ তরুণদের জীবনে কী প্রভাব ফেলছে, তা জানতে সেখানকার চার তরুণের সঙ্গে কথা বলেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল–জাজিরা।
২০১২ সালে রাখাইন রাজ্যের সংখ্যাগুরু আদিবাসী রাখাইন এবং রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে জাতিগত দাঙ্গা শুরু হলে বেশ কয়েকজন নিহত হন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই ছিলেন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর। দাঙ্গায় প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
ওই ঘটনার পর সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের চলাচলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করে এবং ১৯৮২ সালের একটি বৈষম্যমূলক আইনের অধীন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে।
২০১৬ ও ২০১৭ সালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে সন্ত্রাস দমনের নামে মিয়ানমার সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে অভিযান শুরু করে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে ওই অভিযানকে জাতিগত নিধন বলে উল্লেখ করা হয়। অভিযানে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমার সরকার ও সেনা কর্মকর্তাদের বিচারও শুরু হয়েছিল।
২০১৮ সালের শেষ ভাগে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আরাকান আর্মি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। প্রায় দুই বছর ধরে তীব্র লড়াইয়ের পর ২০২০ সালের নভেম্বরে উভয় পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতিতে আসে। কিন্তু মাত্র তিন মাসের মাথায় অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। রক্তপাতহীন অভ্যুত্থান হলেও কয়েক দিনের মাথায় সাধারণ মানুষ অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে গণ–আন্দোলন শুরু করেন। শান্তিপূর্ণ ওই আন্দোলন থামাতে সরকারের দমন-পীড়নে বহু মানুষ নিহত হন।
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে দেশজুড়ে বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু করে। গত বছরের অক্টোবরে কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন জোট গঠন করে ‘অপারেশন ১০২৭’ নামে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। আরাকান আর্মিও ওই জোটে যোগ দেয়।
জুবায়ের বলেন, ‘যুদ্ধ এবং যেভাবে জোর করে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে বাধ্য করা হচ্ছে, তাতে আমার মনে হচ্ছে, মিয়ানমার সেনাবাহিনী সব দিক থেকে রোহিঙ্গা তরুণদের ধ্বংস করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে।’
গত বছরের নভেম্বর থেকে যুদ্ধের কারণে জুবায়েরকে বারবার পালাতে হচ্ছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি থেকে তাঁকে নতুন আরেক ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সেটা হলো জোর করে সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির ভয়।
গত এপ্রিলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সেনাবাহিনী নানা উপায়ে রোহিঙ্গা তরুণদের সেনাবাহিনীতে সংযুক্ত করছে। যেমন নাগরিকত্ব দেওয়ার লোভ দেখিয়ে, রাতে অভিযান চালিয়ে তরুণদের ধরে নিয়ে গিয়ে, এমনকি বন্দুক দেখিয়ে অপহরণও করা হচ্ছে। এভাবে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা তরুণকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁদের কাউকে কাউকে এমনকি আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যুদ্ধক্ষেত্রেও পাঠানো হচ্ছে।
রাজ্যে সংঘাতের তীব্রতা বাড়তে শুরু করলে গত মাসের শেষ দিকে জুবায়ের ও তাঁর মা–বাবা নাফ নদী পেরিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে পালিয়ে যান। তিনি এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছেন।
আরেক তরুণ থুরা মাআং নানা জায়গা ঘুরে মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে পৌঁছান। তিনি সেখানে ভাষাশিক্ষা ক্লাসে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। কেউ নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে রাজি নয়। এর মধ্যেই এপ্রিলে সেনাবাহিনী থেকে তরুণদের বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। হতাশ থুরা মাআং কয়েক সপ্তাহ পর নানা ভয় মাথায় নিয়ে নিজ শহরে ফিরে যান। যে শহরটি তত দিনে আরাকান আর্মির দখলে চলে গেছে।
থুরা যখন উড়োজাহাজে ইয়াঙ্গুন থেকে রাখাইন রাজ্যের রাজধানী সিতেই পৌঁছান, অন্য যাত্রীদের সঙ্গে বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হয় এবং তাঁকে কিছুদিন কোনো অভিযোগ ছাড়াই বৌদ্ধদের ধর্মীয় কেন্দ্রে আটকে রাখা হয়। সেনাসদস্যরা তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন, তাঁর ফোন তল্লাশি করা হয় এবং তাঁর ‘মাগশট’ রাখা হয়। বিশ্বজুড়ে অপরাধীদের কারাগারে পাঠানোর আগে মাগশট তোলা হয়।
থুরার মতো আরও অনেক তরুণ যাঁরা ফেব্রুয়ারিতে রাখাইন রাজ্য থেকে দেশের নানা প্রান্তে ভ্রমণে গেছেন, তাঁদের একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। মার্চে সেনাবাহিনী ট্রাভেল এজেন্ট এবং বাস কোম্পানিকে রাখাইন রাজ্যের বাসিন্দাদের ভ্রমণের টিকিট না দেওয়ার আদেশ জারি করে।
তথ্য পাচার এবং আরাকান আর্মিতে তরুণদের যোগ দেওয়া ঠেকাতেই সেনাবাহিনী এ পদক্ষেপ নেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হতাশ থুরা মাআং এখন মা–বাবাকে না জানিয়ে আরাকান আর্মিতে যোগ দেওয়ার কথা চিন্তা করছেন। বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে, এখন আমার সামনে একটাই পথ খোলা আছে, যেটা আমি করতে পারি।’
থুরার মতো সিতেই বিমানবন্দরে আটক হয়েছিলেন তুন তুন উইন। ২৪ বছরের এই রাখাইন তরুণও একটি ভাষাশিক্ষা ক্লাসে যোগ দিতে ইয়াঙ্গুনে গিয়েছিলেন। পরে তিনি পরিবারের কাছে ফিরে যান।
তুন তুন বলেন, ‘নিজের স্বপ্নপূরণের পথে চলার চেয়ে এ মুহূর্তে বেঁচে থাকাই আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
২৭ বছর বয়সী আরেক তরুণ আরকার হতেত। তিনি রাখাইনের একটি গ্রামে অনলাইনে পণ্য সরবরাহ এবং নাচের প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করতেন। সেনাবাহিনীর কারফিউ জারি, গ্রেপ্তার ও নজরদারির কারণে তাঁর দুই কাজই বন্ধ হয়ে গেছে।
হতেত বলেন, ‘এখন আমার এমনকি বিকেলেও ঘর থেকে বের হতে ভয় হয়। ঘরেও আমরা নিরাপদ নই। কারণ, ছাদের ওপর দিয়ে গোলা উড়ে যায়। সেই সঙ্গে আকাশ থেকেই আমাদের শহরে বোমা ফেলা হচ্ছে।’
গত জানুয়ারিতে এই তরুণের শহর পাউকতা দখল করে আরাকান আর্মি। কিন্তু শহরতলির বেশির ভাগ অংশই এখনো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দখলে।
আরকার হতেত ও তাঁর পরিবার এপ্রিলের শুরুর দিকে আরাকান আর্মি–নিয়ন্ত্রিত একটি শহরতলিতে চলে যায়। আল–জাজিরাকে তিনি বলেন, এখন তিনি ‘৭০ শতাংশ নিরাপদ বোধ করছেন’।
যদিও এই তরুণ যেখানে আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে মে মাসের শেষ দিক ও জুনের শুরুতে লড়াইয়ের তীব্রতা অনেক বেড়ে গেছে। এরপর আল–জাজিরা আর আরকার হতেতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।