আফগানিস্তানে তালেবান কর্তৃপক্ষ ক্ষমতা গ্রহণের আগপর্যন্ত ফাতিমার মতো নারীরা তাঁদের চুল বিক্রি করতে পারতেন। এ থেকে তাঁদের হাতে কিছু টাকা আসত। আফগান নারীদের বিক্রি করা চুল দিয়ে তৈরি হয় পরচুলার মতো নানা ফ্যাশন উপাদান।
গত বছর তালেবান সরকার চুল বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এ কারণে ২৮ বছর বয়সী ফাতিমার মতো নারীদের গোপনে চুল বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে তাঁদের এ কাজে অনেক ঝুঁকি রয়েছে। একবার ধরা পড়ে গেলে তালেবান সদস্যদের হাতে তাঁদের শাস্তি পেতে হবে।
আফগান নারীরা সাধারণত গোসলের পর ঝরে পড়া চুল ও সেলুনের মেঝেতে পড়া চুলগুলো গুছিয়ে বিক্রি করেন। এ চুলের দাম খুব সামান্য।
আফগানিস্তানে ২০২১ সালে তালেবান নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর কাবুলে বেতনভুক্ত বেসরকারি চাকরিতে থাকা কয়েকজন নারীর মধ্যে একজন হচ্ছেন ফাতিমা। মাসে তিনি ১০ হাজার টাকার মতো বেতন পান (১০০ মার্কিন ডলার)। ফাতিমা চুল বিক্রির বিষয়ে বলেন, ‘আমার এ অর্থ প্রয়োজন। এ থেকে আমি নিজের জন্য বা বাড়ির জন্য কিছু কিনতে পারি।’
ফাতিমা অবশ্য নিরাপত্তার খাতিরে তাঁর পুরো নাম প্রকাশ করতে চান না। তিনি বলেন, ১০০ গ্রাম চুল বিক্রি করলে ৩ ডলারের কিছু বেশি অর্থ পাওয়া যায়। মাসে তিনি যে বেতন পান, তাতে সামান্য কয়টা টাকা এতে যুক্ত হয়।
আফগান এই নারী বলেন, যেসব ক্রেতা পরচুলা তৈরির জন্য চুল বিদেশে রপ্তানি করতে চান, তাঁরা চুল সংগ্রহের জন্য আমাদের দরজায় কড়া নাড়েন।
এই চুলের ক্রেতাদের মধ্যে একজন পুরুষ রয়েছেন। তিনি নাম প্রকাশ না করে বলেন, চুল সংগ্রহ করে তা পাকিস্তান ও চীনে পাঠানো হয়।
তালেবান কর্তৃপক্ষ নারীর অধিকারের ওপর কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। জাতিসংঘ একে ‘লিঙ্গ বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করেছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে নারী শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছে। নারীদের কর্মসংস্থানেও বাধা সৃষ্টি করেছে। আফগানিস্তানে নারীদের পার্ক ও ব্যায়ামাগারে যেতে দেওয়া হয় না। এ ছাড়া সৌন্দর্যচর্চার জন্য রূপচর্চাকেন্দ্রও বন্ধ করা হয়েছে।
অনুমতি নেই
তালেবান কর্তৃপক্ষ গত বছর নারী ও পুরুষের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রণকারী ‘পাপ ও পুণ্য আইন’ জারি করে, যার মধ্যে চুলসহ মানবদেহের যেকোনো অংশ বিক্রি নিষিদ্ধের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তবে এই আইন লঙ্ঘনে শাস্তি কী হবে, তা বলা হয়নি।
পুণ্য প্রচার ও পাপ প্রতিরোধ মন্ত্রণালয়ের (পিভিপিভি) মুখপাত্র সাইফুল ইসলাম খাইবার বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা মানুষকে যে রূপ দিয়েছেন, আমাদের তাকে সম্মান করতে হবে এবং তার মর্যাদা রক্ষা করতে হবে। দেশে চুলের ব্যবসা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। তবে এখনো দেহের অঙ্গ বিক্রির অনুমতি নেই।’
অবশ্য চুল বিক্রি এতটাই সংবেদনশীল যে নৈতিকতার বিষয়গুলো পরিচালনাকারী মন্ত্রণালয় গত জানুয়ারিতে কাবুল প্রদেশে প্রায় এক টন মানুষের চুল পুড়িয়ে দিয়েছে। পিভিপিভি এক বিবৃতিতে বলেছে, ইসলামী মূল্যবোধ এবং মানবিক মর্যাদা রক্ষার জন্য চুল পোড়ানো হয়েছে।
তবে তালেবান কর্তৃপক্ষের এসব বিধিনিষেধ ফাতিমাকে আটকাতে পারেনি। নামাজের সময় যখন তালেবান কর্মকর্তা ও বাহিনীর সদস্যরা মসজিদে যান, তখন ফাতিমা তাঁর সংগ্রহ করা চুল একটি স্থানে লুকিয়ে রাখেন। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) তথ্য অনুসারে, বাড়তি কিছু অর্থ আয় করাটা তাঁদের জন্য বেশি জরুরি। কারণ, ৮৫ শতাংশ আফগান প্রতিদিন এক ডলারেরও কম আয় করে থাকেন।
গোপন রূপচর্চাকেন্দ্র
কাবুলের এক গোপন রূপচর্চাকেন্দ্রে দুটি জীর্ণ চামড়ার চেয়ার একটি ছোট ঘরে রাখা হয়েছে। সেখানে হেয়ারড্রেসার হিসেবে কাজ করেন নার্গিস। সপ্তাহে মাত্র চারজন গ্রাহক পান তিনি। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার আগে ৪৩ বছর বয়সী বিধবা এই নারী হেয়ারড্রেসারের প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয়জন গ্রাহক ছিলেন।
এখন তাঁর সবচেয়ে ধনী গ্রাহকেরা সাহস করে রূপচর্চাকেন্দ্রে আসেন। এমনকি তাঁরা মাঝেমধ্যে জিজ্ঞাসা করেন, মূল্যবান অতিরিক্ত চুল কি তাঁরা বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন? নার্গিস বলেন, খুব কম নারীই আছেন, যাঁরা সৌন্দর্য নিয়ে ভাবার সময় পান। অন্যদের জন্য, তালেবানের শাস্তির বিষয়টি সবচেয়ে বড় ঝুঁকির।
ওয়াহিদা নামের ৩৩ বছর বয়সী এক বিধবা নারী কীভাবে তিন সন্তানকে লালন–পালন করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় রয়েছেন। নিজের আট বছর বয়সী মেয়ের ও নিজের চুল তিনি সংগ্রহ করে রাখেন। কেটে ফেলা চুলের তুলনায় গোড়া থেকে উঠে আসা চুল বেশি দামী।
বেকার আফগান নারী, যাঁরা প্রায় সম্পূর্ণরূপে দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করে চলেন, তাঁরা প্লাস্টিকের ব্যাগে পড়া চুল ভরে রাখেন। পরবর্তী সময় বিক্রি করে সামান্য অর্থ আয়ই তাঁদের লক্ষ্য। নিজের বাড়িতে বসে ওয়াহিদা বলেন, ‘আমি যখন চুল বিক্রি করতে পারতাম, তখন কিছুটা আশা ছিল। কিন্তু এখন এটা নিষিদ্ধ। আমি ভেঙে পড়েছি। আশা করি, ক্রেতারা আবার চুল কিনতে আমার দরজায় আসবেন।’
ওয়াহিদা আরও বলেন, ‘চুল কোথায় বিক্রি হয়, আমি তা জানি। কিন্তু সেখানে ধরা পড়ার ভয়ে আমি যেতে পারি না।’
অনুবাদ: মো. মিন্টু হোসেন