কাবুল দখলের তৃতীয় বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছে তালেবানের নিরাপত্তাকর্মীরা। বাগরাম বিমানঘাঁটিতে, ১৪ আগস্ট ২০২৪
কাবুল দখলের তৃতীয় বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছে তালেবানের নিরাপত্তাকর্মীরা। বাগরাম বিমানঘাঁটিতে, ১৪ আগস্ট ২০২৪

তালেবান শাসনের তিন বছর, কেমন আছে আফগানিস্তান

আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এদিন দ্বিতীয়বারের মতো কাবুলের ক্ষমতায় বসে তালেবান। বিদ্রোহী থেকে শাসকে পরিণত হয়ে নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ইসলামিক শাসন শুরু করে তারা। এখন পর্যন্ত তারা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়নি। তাই নিজেদের বৈধতার দাবি জোরদার করতে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে তালেবান।

বিশ্বের কোনো দেশ এখন পর্যন্ত তালেবানকে আফগানিস্তানের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি না দিলেও তারা চীন ও রাশিয়ার মতো আঞ্চলিক বড় শক্তিগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বৈঠক করেছে। এমনকি তাদের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন বৈঠকেও অংশ নিয়েছেন। চাপ সত্ত্বেও জাতিসংঘের এসব বৈঠকে কোনো নারী বা নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রাখেনি তালেবান।

দেশের ভেতরে তালেবান শাসনের প্রতি এখন পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। বিদেশি কোনো শক্তিকে এখন পর্যন্ত দেশটির অভ্যন্তরের কোনো পক্ষকে সমর্থন করারও তেমন কোনো আগ্রহ চোখে পড়েনি। কারণ, ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ বিশ্বের পুরো মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। এ ছাড়া একসময় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তালেবানকে যেমনটি হুমকি মনে করা হতো, এখন তেমনটি মনে করা হয় না। কিন্তু আফগানিস্তান নিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।

সংস্কৃতির যুদ্ধ ও পুরস্কার

তালেবানের শাসনব্যবস্থায় নেতৃত্বের কাঠামো পিরামিড আকৃতির। সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা এই পিরামিডের শীর্ষে থাকেন। পিরামিডের এক পাশে থাকে মসজিদ ও ধর্মীয় নেতারা। অন্য পাশে রাজধানী কাবুলকেন্দ্রিক প্রশাসন। এ প্রশাসন ধর্মীয় নেতাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিনিধিদল ও বিদেশি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে।

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের অনাবাসিক বিশেষজ্ঞ জাবিদ আহমদ বলেন, ‘(তালেবানের শাসনব্যবস্থায়) ভিন্ন ভিন্ন রকমের চরমপন্থা রয়েছে। কট্টরপন্থী ও রাজনৈতিকভাবে বাস্তবসম্মত নেতাদের সমন্বয়ে তালেবান সরকার গঠিত। সরকারের এই বৈশিষ্ট্য তাঁদের সংস্কৃতির যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

তালেবানের বর্তমান সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। নিয়ম অনুযায়ী, তালেবানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার অবসর নেওয়া বা পদত্যাগ করার কোনো নিয়ম নেই। আমৃত্যু তিনি এ পদে থাকেন। তাই আখুন্দজাদার জীবদ্দশায় তালেবানের সবচেয়ে বিতর্কিত নীতিগুলোর পরিবর্তনের তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই।

ক্রাইসিস গ্রুপের দক্ষিণ এশিয়া প্রোগ্রামের কর্মকর্তা ইব্রাহিম বাহিস বলেন, ‘তালেবানরা ঐক্যবদ্ধ। তাই আরও অনেক বছর তারা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে। তারা একটি গোষ্ঠী হিসেবে শাসন করে, একটি গোষ্ঠী হিসেবে যুদ্ধ করে।’

এসব কিছুর কারণে তালেবান নেতাদের মধ্যে মতভিন্নতা তৈরি করা গেলে তাদের মধ্যে ফাটল ধরানো যেতে পারে বলে মনে করেন বাহিস।

প্রশাসনে ঐক্য ও শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের রণক্ষেত্র থেকে ঝানু তালেবান নেতাদের প্রশাসনে নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁদের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের শীর্ষ পদে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

যেসব নেতা পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন, তাঁদের অনেককে নানাভাবে পুরস্কৃত করতে হয়েছে বলে মনে করেন জাবিদ আহমদ। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য সবাইকে কমবেশি পুরস্কৃত করা হয়েছে। অনেককে প্রাদেশিক সরকারে ইচ্ছামতো হস্তক্ষেপের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। অনেককে তৃতীয় বা চতুর্থ বিয়ের অনুমতি দিতে হয়েছে। কাউকে নতুন একটি ট্রাক দেওয়া হয়েছে। কাউকে দেওয়া হয়েছে শুল্কের ভাগ কিংবা বেদখল কোনো বাড়ির চাবি।’

দেশ যেভাবে চলছে

তালেবানের বর্তমান প্রশাসনকে ‘আফগানিস্তানের আধুনিক সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার’ বলে মনে করেন ক্রাইসিস গ্রুপের বাহিস। এই বিশেষজ্ঞের মতে, ‘তারা চাইলে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত গ্রামপর্যায়ে নিখুঁতভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে।’

মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের জাবিদ আহমদের মতে, আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তারাই দেশটিকে সচল রেখেছেন। তাঁদের প্রশাসনের দাপ্তরিক কাজ পরিচালনার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা রয়েছে। কিন্তু তালেবানের বেসামরিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের দপ্তর পরিচালনার কোনো আনুষ্ঠানিক জ্ঞান নেই। তাঁদের সব যোগ্যতা ঐশ্বরিক।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেক্টোরাল অ্যাসিস্ট্যান্সের লীনা রিকিলা তামাং মনে করেন, তালেবানের দেশ পরিচালনার বৈধতা জনগণের কাছ থেকে পাওয়া নয়। তারা নিজেদের মতো ধর্ম ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যা দিয়েই দেশ পরিচালনা করেছে।

আশা ধরে রাখতে হবে

আফগানিস্তানের অর্থনীতি ক্রমশ দুর্বল হয়েছে। ২০২৩ সালেও দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৩০ শতাংশ এসেছে বিদেশি সহায়তা থেকে।

গত তিন বছরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার মাধ্যমে আফগানিস্তানে অন্তত ৩৮০ লাখ ডলার সহায়তা দিয়েছে জাতিসংঘ। এ সময়ে দেশটিতে এককভাবে সবচেয়ে বেশি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তালেবানের ক্ষমতা গ্রহণের পর দেশটিতে মার্কিন সহায়তা এসেছে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। কিন্তু এসব সহায়তার একটি বড় অংশ প্রয়োজনীয় খাতের পরিবর্তে অন্য দিকে চলে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

রাজস্ব সংগ্রহের জন্য তালেবান নানা ধরনের কর নির্ধারণ করেছে। ২০২৩ সালে তারা প্রায় ২৯৬ কোটি ডলার রাজস্ব সংগ্রহ করেছে। কিন্তু ধুঁকতে থাকা অর্থনীতিটি চাঙা করতে তাদের আরও অনেক বেশি অর্থ প্রয়োজন। অথচ তালেবানের হাতে তা করার তেমন কোনো পথ নেই।

আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রা ছাপাতে পারে না। তাদের বিদেশে মুদ্রা নোট ছাপাতে হয়। দেশটিতে সুদের লেনদেনও নিষিদ্ধ। তাই ব্যাংকগুলো অর্থ ধার দেওয়া বন্ধ রেখেছে। আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃত না হওয়া তালেবান সরকার বিদেশ থেকে ঋণসহায়তাও পাচ্ছে না। দেশটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেনও বন্ধ।

এর বাইরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রতিবেশী পাকিস্তান থেকে ফিরতে থাকা নিজ দেশের শরণার্থী নাগরিকের ঢল তালেবানের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ।

তালেবান নারীশিক্ষা প্রায় নিষিদ্ধ করেছে। সব ধরনের চাকরি থেকে নারীদের বরখাস্ত করেছে। এসব কিছুও দেশটির অর্থনীতির জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা।

বাহিস মনে করেন, এত সব চাপ, অভাব ও চ্যালেঞ্জ তালেবান সরকার বেশি দিন সহ্য করতে পারবে না। জনগণ একদিন জেগে উঠবে। সেই পর্যন্ত সবাইকে আশা ধরে রাখতে হবে।

কূটনীতি

তালেবান সরকারকে এখনো বিশ্বের কোনো দেশ স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু চীন ও রাশিয়ার মতো দেশটির বড় প্রতিবেশীরা মনে করে, একটি স্থিতিশীল আফগানিস্তান তাদের জন্য মঙ্গলজনক।

কিন্তু বিদেশে তালেবানের জব্দ অর্থ ও সম্পদ ফেরত পেতে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন খুব দরকার। যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিলে অন্য পশ্চিমা দেশগুলোও তালেবানকে স্বীকৃতি দেবে।

আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তালেবানের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করছে। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে কাতার। আর আমিরাতের উড়োজাহাজ সংস্থার সহায়তাও তালেবানের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

নিরাপত্তাব্যবস্থা

অসংখ্য পাহারাচৌকি, সাঁজোয়া যান ও হাজার হাজার যোদ্ধা নিয়ে তালেবান নিজেদের নিরাপত্তা একধরনের নিশ্চিত করেছে। কিন্তু দেশটি নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপদ নয়। আত্মঘাতী বোমা হামলা ও ধারাবাহিক সন্ত্রাসী হামলায় দেশটিতে প্রায় সময় হতাহতের ঘটনা ঘটে।

আফগানিস্তানের সক্রিয় ইসলামিক স্টেট (আইএস) কাবুলের দাশত-ই-বারছির শিয়া জনগোষ্ঠীর ওপর প্রায় সময় বোমা হামলা চালায়। আদর্শগত মতবিরোধ থাকা সত্ত্বেও আইএসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না তালেবান। এখন পর্যন্ত কোনো সন্ত্রাসী হামলার বিচার করতে পারেনি তারা।

আফগানিস্তানের নারীরা প্রায় দুই দশক স্বাধীনতা ভোগ করার পর এখন আবার অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। নারীদের পোশাক, কর্ম ও ভ্রমণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তালেবান সরকার।

গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে অনেক গণমাধ্যম তৈরি হয়েছিল। তালেবান আসার পর অধিকাংশ গণমাধ্যম বন্ধ হয়ে গেছে। তবে মূলধারার কিছু গণমাধ্যম এখনো কোনোভাবে কাজ করছে।

যুক্তরাজ্যের এক্সেটার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের লেকচারার বলেন, ‘আফগানিস্তানের মূলধারার গণমাধ্যমগুলো তালেবানের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, তারা কার নিরাপত্তা নিয়ে স্বস্তি প্রকাশ করছে?’