আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ পরিচালিত এক হামলায় জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হয়েছেন। গত রোববার ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হন। কীভাবে একজন শল্যচিকিৎসক থেকে বৈশ্বিক জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ পদে পৌঁছে যান জাওয়াহিরি, এক প্রতিবেদনে তা তুলে ধরেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
ওসামা বিন লাদেনের পর আল-কায়েদার হাল ধরেন আয়মান আল-জাওয়াহিরি। এর আগে বহু বছর তিনি ছিলেন এর মূল সংগঠক ও কৌশল নির্ধারণকারী। কিন্তু ব্যক্তিগত ক্যারিশমার অভাব ছিল জাওয়াহিরির। প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের প্রতিযোগিতার মধ্যেও পড়েছিলেন তিনি। এতে পশ্চিমা বিশ্বের ওপর চোখধাঁধানো কোনো হামলায় তাঁর উৎসাহ জোগানোর সামর্থ্য হোঁচট খায়।
যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ৭১ বছর বয়সী জাওয়াহিরি নিহত হন। টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত ভাষণে স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ কথা জানান। মার্কিন কর্মকর্তারা বলেন, রোববার আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে এ হামলা চালানো হয়েছিল।
২০১১ সালে আরব বসন্ত জাগরণ নামে আরব দেশগুলোয় বিদ্রোহের কারণে আল-কায়েদা অনেকটাই গুরুত্বহীন হয়ে পড়লে জাওয়াহিরি তা হতাশ হয়ে দেখেছিলেন। কয়েক দশকের স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে মূলত মধ্যবিত্ত অ্যাকটিভিস্ট ও বুদ্ধিজীবীরা এই বিদ্রোহ শুরু করেছিলেন।
বিন লাদেনের মৃত্যুর পর মার্কিন বিমান হামলায় জাওয়াহিরির ডেপুটিরা একের পর এক নিহত হন। এতে অভিজ্ঞ এই মিসরীয় জঙ্গির বৈশ্বিক সমন্বয়ের কাজটি দুর্বল হয়ে পড়ে।
অনমনীয় ও লড়াকু ব্যক্তিত্বের জন্য সুনাম ছিল জাওয়াহিরির। কিন্তু এরপরও বিশ্বজুড়ে শিথিল সম্পর্ক রেখে চলা গোষ্ঠীগুলোর দেখভালের কাজটা তিনি করতে পেরেছিলেন। স্থানীয়ভাবে ধ্বংসাত্মক বিদ্রোহ চালাতেই এসব গোষ্ঠী বেড়ে উঠেছিল। আরব বসন্তের কারণে সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে কিছু গোষ্ঠীর জন্ম হয়। সহিংসতার কারণে এশিয়া, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সংগঠনের উচ্চপর্যায়ের চক্রান্তকারীদের পরিকল্পনায় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু এভাবে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত হওয়া আল-কায়েদার দিনগুলো অনেক আগেই ফুরিয়েছে। এর পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে আন্তদেশীয় জিহাদি নেটওয়ার্কের উসকানি ও এলাকাভিত্তিক ক্ষোভ মিলিয়ে জঙ্গিবাদ স্থানীয় পর্যায়ের সংঘাতে রূপ নিয়ে তার মূলে ফিরে গেছে।
ইসলামি জঙ্গিবাদে আয়মান আল-জাওয়াহিরির পথচলা কয়েক দশক আগে থেকে। মিসরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ১৯৮১ সালে আততায়ীর হাতে নিহত হন। এ ঘটনায় আদালতের এজলাসে রাখা খাঁচায় (হাজতখানা) যখন জাওয়াহিরি দাঁড়িয়েছিলেন, তখন প্রথমবারের মতো বিশ্ব তাঁর কথা জানতে পারে।
সাদা পোশাকে খাঁচায় বন্দী জাওয়াহিরিকে চিৎকার করে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা ত্যাগ স্বীকার করেছি এবং ইসলামের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এখনো আরও ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত আছি।’ ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করায় সাদাতের ওপর ক্ষুব্ধ অন্য আসামিরা এ সময় স্লোগান দিতে থাকেন।
অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে জাওয়াহিরিকে তিন বছর কারাভোগ করতে হয়। তবে মূল অভিযোগ থেকে তাঁকে খালাস দেওয়া হয়েছিল।
জাওয়াহিরির একটি ছদ্মনাম ‘চিকিৎসক (দ্য ডক্টর)’। সাজাভোগ শেষে প্রশিক্ষিত এই শল্যচিকিৎসক পাকিস্তানে যান। সেখানে তিনি রেড ক্রিসেন্টের সঙ্গে কাজ করেন। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে লড়াইয়ে আহত মুজাহিদীন গেরিলাদের চিকিৎসা দেন। ওই সময় তিনি বিন লাদেনের সঙ্গে পরিচিত হন। ধনী এই সৌদি নাগরিক আফগান প্রতিরোধ যুদ্ধে যোগ দেন।
১৯৯৩ সালে মিসরে ইসলামিক জিহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন জাওয়াহিরি। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সরকার উৎখাত ও একটি বিশুদ্ধ ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এতে ১ হাজার ২০০–র বেশি মিসরীয় নিহত হন।
১৯৯৫ সালের জুনে আদ্দিস আবাবায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে গুপ্তহত্যার চেষ্টা চালানো হয়। এরপর ইসলামিক জিহাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন অভিযান চালায় মিসর সরকার।
এর প্রতিক্রিয়া ধূসর, সাদা পাগড়িধারী জাওয়াহিরি ১৯৯৫ সালে ইসলামাবাদে মিসরীয় দূতাবাসে হামলার নির্দেশ দেন। বিস্ফোরকভর্তি দুটি গাড়ি দূতাবাস কম্পাউন্ডের ফটকে আঘাত হানে। এতে ১৬ জন নিহত হন।
১৯৯৯ সালে জাওয়াহিরির অনুপস্থিতিতে মিসরের সামরিক আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আর তখন বিন লাদেনকে আল-কায়েদা গঠনে সাহায্য করার পর তিনি আয়েশি জীবন ফেলে জঙ্গির জীবনযাপন শুরু করেন।
২০০৩ সালে আল-জাজিরার সম্প্রচারিত একটি ভিডিওতে দেখা যায়, দুই ব্যক্তি একটি পাথুরে পাহাড়ের ওপর দিয়ে হাঁটছেন। পশ্চিমা গোয়েন্দারা আশা করেছিলেন, এই চিত্র তাঁদের আস্তানা সম্পর্কে ক্লু সরবরাহ করবে।
কয়েক বছর ধরে আয়মান আল-জাওয়াহিরি পাকিস্তান-আফগানিস্তানের নিষিদ্ধ সীমান্তে লুকিয়ে আছেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। পাকিস্তানের গোপন আস্তানায় অভিযান চালিয়ে বিন লাদেনকে হত্যা করে মার্কিন নেভি সিল। এরপর ২০১১ সালে আল-কায়েদার নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তিনি। তখন থেকে পাশে এফ-৪৭ বন্দুক রেখে ভিডিও বার্তায় বারবার বৈশ্বিক জিহাদের ডাক দিয়ে আসছিলেন জাওয়াহিরি।
বিন লাদেনের প্রশংসা করে দেওয়া বক্তৃতায় জাওয়াহিরি পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। সৌদি বংশোদ্ভূত এই জঙ্গির হুমকির কথাটি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘তোমরা কখনো নিরাপত্তার স্বপ্ন দেখতে পারবে না যতক্ষণ না আমরা বাস্তবে সেই নিরাপত্তায় বাস করি এবং যতক্ষণ না তোমরা মুসলিমদের ভূখণ্ড ছেড়ে যাও।’
এরপর দেখা যায়, ইরাক ও সিরিয়ায় ২০১৪-১৯ সালে আরও কট্টর ইসলামিক স্টেট গোষ্ঠীর (আইএসআই) উত্থান পশ্চিমা সন্ত্রাসবিরোধী কর্তৃপক্ষের বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে; যদিও এখন আর তেমনটি নেই। বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছে ইসলামিক স্টেট।
জাওয়াহিরি প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতি কিংবা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে টেনে অনলাইনে দেওয়া বক্তব্যে মুসলিম তরুণদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। কিন্তু তাঁর বক্তব্যে বিন লাদেনের মতো আকর্ষণশক্তির অভাব আছে বলে মনে করা হয়।
জাওয়াহিরি আল-কায়েদার কয়েকটি বড় অভিযানে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তিনি ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে হামলার প্রস্তুতিতে সহযোগিতা করেছিলেন, যখন যুক্তরাষ্ট্রে তিন হাজার মানুষকে হত্যায় ছিনতাই করা উড়োজাহাজ ব্যবহার করেছিল আল-কায়েদা।
১৯৯৮ সালে কেনিয়া ও তানজানিয়ায় মার্কিন দূতাবাসে বোমা হামলার ভূমিকার জন্য জাওয়াহিরিকে অভিযুক্ত করা হয়। এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা জাওয়াহিরির মাথার জন্য ২ কোটি ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল এই মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা।
কায়রোর কোনো বস্তিতে জাওয়াহিরির জন্ম হয়নি। মহৎ উদ্দেশ্য সাধনের কথা বলে অন্যদের যেভাবে জঙ্গি সংগঠনে টানা হয়, ওই রকম কেউ নন তিনি। ১৯৫১ সালে কায়রোর এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে তাঁর জন্ম। ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদগুলোর একটি আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমামের নাতি জাওয়াহিরি।
জাওয়াহিরির বেড়ে ওঠা কায়রোর পত্রপল্লবে শোভিত মাদি উপশহরে। এটি ছিল পশ্চিমা পর্যটকদের পছন্দের জায়গা, যেসব পশ্চিমা দেশের তিনি বিরোধিতা করেছিলেন। ফার্মাকোলজির অধ্যাপকের ছেলে জাওয়াহিরি প্রথম ইসলামি মৌলবাদ গ্রহণ করেন ১৫ বছর বয়সে।
জাওয়াহিরি মিসরীয় লেখক সাইয়িদ কুতুবের বিপ্লবী মতাদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। সরকার উৎখাতের চেষ্টার অভিযোগে ১৯৬৬ সালে এই ইসলামি ব্যক্তিত্বের ফাঁসি হয়।
১৯৭০–এর দশকে কায়রো ইউনিভার্সিটির মেডিসিন অনুষদে জাওয়াহিরির সঙ্গে যাঁরা পড়াশোনা করেছেন, তাঁকে প্রাণবন্ত তরুণ বলছেন তাঁরা। তিনি সিনেমা দেখতেন, গান শুনতেন এবং বন্ধুদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করতেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাওয়াহিরির এক সহপাঠী চিকিৎসক বলেন, ‘যখনই সে কারাগার থেকে বের হলো, তখন সে সম্পূর্ণ আলাদা এক এক মানুষ।’
সামরিক কুচকাওয়াজে প্রেসিডেন্ট সাদাত আততায়ীর হাতে নিহত হওয়ার পর আদালতকক্ষে আসামি রাখার খাঁচা থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন জাওয়াহিরি। তিনি বলেন, বেত্রাঘাত, উন্মত্ত কুকুরের আক্রমণসহ কারাগারে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জঙ্গিরা।
চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে তাঁর পাশে বসা এক ব্যক্তি ও অন্য জঙ্গিদের প্রসঙ্গ টেনে জাওয়াহিরি বলেন, ‘নিরপরাধ এই বন্দীদের মানসিক চাপ দিতে একটি মামলায় তারা (প্রশাসন) স্ত্রী, মা, বাবা, বোন ও সন্তানদেরও গ্রেপ্তার করেছে।’
কারাগারে জাওয়াহিরির সঙ্গে থাকা বন্দীরা বলেন, এমন পরিস্থিতি তাঁকে আরও উগ্রপন্থী করে এবং বৈশ্বিক জিহাদের পথে নিয়ে যায়।