‘আফগানিস্তানে তালেবান যখন নারীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দুয়ার বন্ধ করে দিল, তখন আমার একমাত্র আশা ছিল বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া।’
এই কথাগুলো নাতকাইয়ের (ছদ্মনাম)। বয়স ২০ বছর। গত ২৩ জুলাই বিমানবন্দরে যেতে তিনি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নেন। উদ্দেশ্য বাইরে পড়তে যাওয়া। কিন্তু সেই স্বপ্ন তাঁর পূরণ হলো না। তালেবান তাঁকে বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেওয়ার পর বিবিসিকে এসব বলেন তিনি।
নাতকাই বৃত্তি পেয়েছিলেন সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের। আমিরাতের ধনকুবের শেখ খালাফ আহমাদ আল হাবতুর এই বৃত্তি দিয়ে থাকেন। বিবিসি জানতে পেরেছে, নাতকাই ছাড়াও এই বৃত্তি পেয়েছেন আফগানিস্তানের শতাধিক নারী। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে আফগানিস্তান ছেড়েছেন। কিন্তু অনেকেরই এই বৃত্তি নিয়ে আমিরাতে পড়তে যাওয়ার সুযোগ বন্ধ করেছে তালেবান। কমপক্ষে ৬০ জন নারীকে তালেবান বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
২০২১ সালের আগস্টে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। এর পর থেকেই দেশটিতে নারীদের অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। নারীরা চাকরিচ্যুত হয়েছেন। অনেক নারীর ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার তালেবানের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যেসব নারী অবস্থান নিচ্ছেন, তাঁদের ওপর নেমে আসছে নির্যাতন।
নাতকাই বলেন, দেশে নারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবেন না, এমনটা জানার পরও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
‘এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের পড়ার সুযোগ বন্ধ হওয়ার পর আমার বোনের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছিল দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি। সে আশা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসেছে চোখের জল নিয়ে। তার সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’শামস আহমাদ, আফগানিস্তানের নাগরিক
নাতকাইয়ের এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না। কারণ, আফগানিস্তানে নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পর নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয় দুবাইয়ে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে আফগান নারীদের জন্য ওই বৃত্তি ঘোষণা করা হয়। নাতকাই সেই বৃত্তি পেয়েছিলেন। তবে স্বপ্ন পূরণ হলো না।
নাতকাই যখন এ নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন গলা ধরে আসছিল। বলেন, ‘বিমানবন্দরে তালেবান সদস্যরা যখন আমার টিকিট ও ভিসা দেখলেন, তখন বললেন, “শিক্ষার্থী ভিসা নিয়ে নারীরা আফগানিস্তান ত্যাগ করতে পারবেন না।”’
পরিস্থিতি আরও কঠিন
বিমানবন্দর থেকে যাঁদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অনেকের ছবি দেখেছে বিবিসি। এতে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে আছেন নারীরা। তাঁদের সবাই হিজাব পরা। বাইরে যেতে না দেওয়ায় তাঁদের চোখেমুখে হতাশার ছাপ।
নারীদের একা ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে তালেবান। কেউ বাইরে যেতে চাইলে তাঁকে স্বামী কিংবা ভাই, কিংবা চাচা, কিংবা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। একে বলা হচ্ছে মাহরাম। যাঁর অর্থ পুরুষ সঙ্গী।
কিন্তু এই পুরুষ সঙ্গী নিয়ে গিয়েও অনেকে পার পাননি। নাতকাই বলেন, এমন পুরুষ সঙ্গী নিয়ে তিন নারী উড়োজাহাজেও উঠেছিলেন। কিন্তু নীতি ও নৈতিকতাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা পরে তাঁদের উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে দেন।
তালেবানের ভয়ে এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলার সাহস পাচ্ছেন না অনেকে। যাঁরা কথা বলছেন, তাঁরা না প্রকাশ করছেন না। তাঁদের একজন শামস আহমাদ (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের পড়ার সুযোগ বন্ধ হওয়ার পর আমার বোনের জন্য নতুন আশার সঞ্চার করেছিল দুবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তি। সে আশা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছিল। কিন্তু ফিরে এসেছে চোখের জল নিয়ে। তাঁর সব অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’
পুরুষ সঙ্গী ছাড়া দেশের বাইরে যাওয়া যাবে না, এমন শর্ত পূরণ করতে অনেক নারী অর্থ ধার করেছেন। এই অর্থ ধার মূলত পুরুষ সঙ্গীর ভিসার খরচ জোগাড় করতে। শামস আহমাদ বলেন, এমন অনেক নারী বৃত্তি পেয়েছেন, যাঁরা খুবই গরিব এবং অসহায়। এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে নিজের নথিপত্র সত্যায়ন করতে পাঁচ মার্কিন ডলার দেওয়ার সামর্থ্য নেই, এমন অনেকেই এ বৃত্তি পেয়েছেন।
কিন্তু এরপরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। পুরুষ সঙ্গী নিয়েও দেশ ছাড়তে না পেরে অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বিমানবন্দর থেকে ভিডিও বার্তায় এক নারী বলেন, ‘আমরা এখন বিমানবন্দরে আছি। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো সরকার আমাদের দুবাই যেতে দিচ্ছে না। এমনকি যাঁদের সঙ্গে পুরুষ সঙ্গী আছে, তাঁদেরও যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা জানি না, কী করব। দয়া করে সাহায্য করুন।’
বৃত্তি পেয়ে নারীরা যে আমিরাতে যেতে পারছেন না, তা নিশ্চিত করেছে দুবাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৃত্তি প্রদানকারী ওই ধনকুবের আল হাবতুর। এক্সে (সাবেক টুইটার) একটি ভিডিও বার্তা দিয়ে আল হাবতুর তালেবান সরকারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন।
আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
তালেবানের এই সিদ্ধান্তের কড়া সমালোচনা করেছেন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও কূটনীতিকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিথার বার বলেন, তালেবান ইতিমধ্যে নারী ও মেয়েশিশুদের পড়ার সুযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর নতুন পদক্ষেপ ভয়ংকর। তালেবানের নিষ্ঠুরতার নতুন ধাপ হলো নারীদের বাইরে পড়তে যেতে না দেওয়া।
এ নিয়ে কথা বলেছেন আফগানিস্তানে সাবেক যুব প্রতিনিধি শুকুলা জাদরান। দুবাই বিশ্ববিদ্যালয় যাতে আফগান নারীদের বৃত্তি বাতিল না করে, সেই আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
তালেবান এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। আফগানিস্তানের নীতি–নৈতিকতাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মোহাম্মদ সাদিত আকিফ মুহাজির দাবি করেছেন, তিনি এ বিষয়ে কিছু জানেন না। একই কথা বলেছেন তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ।
তালেবানের এমন পদক্ষেপে হতাশ নারীরা। নাতকাই বলেন, ‘আমি এমন একটি দেশে জন্ম নেওয়ার কারণে এই বৃত্তি হারালাম, যেখানে নারী হয়ে জন্ম নেওয়াই যেন অপরাধ। আমি ব্যথিত এবং আমি জানি না আমি কী করব বা আমার সঙ্গে কী হবে।’