মিয়ানমারে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর অগ্রগতিতে জান্তার ওপর চাপ বাড়ছে। দেশটির রাখাইন রাজ্যে আরও একটি শহর দখলের দাবি করেছে আরাকান আর্মি (এএ)। জান্তা বাহিনীর দুজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে আটক করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে তারা। এরই মধ্যে জান্তা বাহিনী মিয়ানমারের নাগরিকদের সামরিক বাহিনীতে যোগদান বাধ্যতামূলক করেছে। এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের শঙ্কা, সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়াতে দেশ ছাড়তে পারেন মিয়ানমারের তরুণেরা।
মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সঙ্গে সরকারবিরোধী ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের লড়াই চলছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়েছে তারা। বিদ্রোহীদের দমাতে হোঁচট খেয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি একটি আইন পাস করে জান্তা সরকার। ওই আইন অনুযায়ী, ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষ ও ১৮ থেকে ২৭ বছর বয়সী নারীদের বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে হবে। তাঁদের সর্বোচ্চ দুই বছর বাহিনীতে দায়িত্ব পালন করতে হবে। তবে রাষ্ট্রে জরুরি অবস্থার সময় এটি পাঁচ বছরও হতে পারে।
আইন অনুযায়ী সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে সক্ষম মিয়ানমারে এমন ১ কোটি ৪০ লাখ নাগরিক রয়েছেন। এরই মধ্যে নতুন আইনটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে কি না, তা যাচাইয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার ১৮ সদস্যের একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী এপ্রিলে প্রথম ধাপে পাঁচ হাজার সদস্যকে সেনাবাহিনীতে যুক্ত করা হবে। আর কেউ এই আইন লঙ্ঘন করে পালাতে চাইলে তাঁকে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের অনেক তরুণ প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। থাইল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর এডুকেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক উ হতো চিত বলেন, ‘আমি শুনেছি, ১৮ বছরের বেশি বয়সী তরুণেরা যেকোনো উপায়ে মিয়ানমার ছাড়তে চাইছেন। এ অবস্থায় থাইল্যান্ডে অবৈধ অভিবাসী শ্রমিক আরও বাড়বে। ফলে সেখানে শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাও বৃদ্ধি পাবে।’
‘সুযোগ পেলে হাতছাড়া করব না’
মিয়ানমারে ২০২১ সালে গণতন্ত্রপন্থী অং সান সু চি সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হটিয়ে ক্ষমতায় বসে জান্তা সরকার। এর পর থেকেই ভালো চাকরির খোঁজে দেশটি থেকে চলে গেছেন হাজার হাজার মানুষ। বেশির ভাগেরই গন্তব্য ছিল থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। ১০ ফেব্রুয়ারির আইনের পর আরও অনেকে বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়া ও খরচা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খোঁজখবর নিচ্ছেন।
দেশ ছাড়তে চাওয়া এমনই একজন ইয়াঙ্গুনের ২৯ বছর বয়সী এক তরুণ। পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আইনটির কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে পড়েছি। আমাদের সঙ্গে অবিচার হচ্ছে। আর আমরা কিছুই করতে পারছি না। কীভাবে এই আইন এড়ানো যায়, তা নিয়েই এখন ভাবছি। আমি নিশ্চিত, সাধারণ মানুষের দেশত্যাগ ঠেকাতে সরকার সব কৌশল কাজে লাগাবে। এরপরও যদি আমি চলে যাওয়ার সুযোগ পাই, তা হাতছাড়া করব না।’
মানুষের বিদেশে যাওয়া ঠেকাতে এরই মধ্যে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে জান্তা সরকার। নিজ বাসা থেকে বা ভ্রমণের সময় অনেক তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে কানাঘুষা চলছে। মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ বিমান চলাচলের ওপরও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সবশেষ গত মঙ্গলবার বিদেশে কর্মী পাঠানোয় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মিয়ানমার সরকার।
রাখাইনে আরও এক শহর দখল
মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জান্তাবিরোধী এ তৎপরতা শুরু হয়েছিল ২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর। তখন থেকেই ভিন্ন মতের ওপর চরম দমনপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে জান্তা সরকার। এ অবস্থায় জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন অনেকে। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীরাও।
গত বছরের অক্টোবর থেকে মিয়ানমারের এই বিদ্রোহীদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল দখলে নিয়েছেন তাঁরা। সর্বশেষ বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী রাখাইন রাজ্যের আরও একটি শহর দখলের দাবি করেছে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।
এক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানিয়েছে, গতকাল বৃহস্পতিবার রাখাইনের মিয়েবন শহর দখল করেছে তারা। এর আগে বিগত তিন মাসে রাখাইন ও চিন রাজ্যের পালেতওয়া, পাউকতাও, কিয়াউকতাও, মিনবিয়া ও ম্রাউক-উ শহর দখল করেছে বিদ্রোহীরা।
গতকালও রাখাইনে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল লড়াই হয়েছে। পৃথক বিবৃতিতে আরাকান আর্মি জানিয়েছে, রাখাইন ও চিন রাজ্যে সাম্প্রতিক লড়াইয়ে সামরিক বাহিনীর জ্যেষ্ঠ দুই কর্মকর্তাকে আটক করেছে তারা। এ ছাড়া দুই কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। আরেকজন নিখোঁজ রয়েছেন। এ সময় সামরিক বাহিনীর বহু অস্ত্র ও গোলাবারুদ জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে রাজ্যের উপকূলবর্তী তিন শহর মংডু, রামরি ও রাথেডংয়ে জান্তা বাহিনীর ওপর হামলা বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে আরাকান আর্মিসহ তিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স। তাদের দাবি, এসব শহরে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ঘাঁটি রক্ষায় সেগুলোর আশপাশে ব্যাপক বোমা ফেলছেন সেনারা। এই তিন শহরে তাঁরা রক্ষণাত্মক অবস্থানে রয়েছেন।