তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্প

খাদ্যসংকট, বরফঠান্ডায় কাবু গৃহহীন লাখো মানুষ

কখনো কখনো তাপমাত্রা নেমে আসছে হিমাঙ্কের নিচে। তীব্র শীত থেকে বাঁচতে আগুন পোহাচ্ছেন গৃহহীন মানুষেরা। গতকাল তুরস্কের কাহরামানমারাসে
 ছবি: রয়টার্স

তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী যে কটি অঞ্চল ভূমিকম্পে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখানে ২ কোটি ৩০ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। ঘরবাড়ি ধসে যাওয়ায় এসব অঞ্চলের লাখ লাখ মানুষ এখন গৃহহীন। প্রচণ্ড শীতের মধ্যে খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছেন তাঁরা।

এদিকে যথেষ্ট ত্রাণ না পৌঁছানোয় খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে দুর্গত এলাকাগুলোতে। পরিস্থিতি এমন যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছে, ভূমিকম্পে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁদেরও অনেকে মারা যেতে পারেন আশ্রয়, খাবার, সুপেয় পানি ও জ্বালানির অভাবে।

গত সোমবার ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। রিখটার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৮। এতে তুরস্কের ১০টি ও সিরিয়ার ৪টি প্রদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভূমিকম্পে মৃত মানুষের সংখ্যা ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (বাংলাদেশ সময়) রাত ১টা পর্যন্ত তুরস্কে এ সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ১৩৪। আর সিরিয়ায় মারা গেছেন ৩ হাজার ৩১৭ জন। এক দিন আগে মৃতের মোট সংখ্যা ছিল ১১ হাজারের কিছু বেশি।

ভূমিকম্পে সিরিয়া ও তুরস্কের ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে এখন বরফজমা শীত। পাশাপাশি মাঝেমধ্যে হচ্ছে বৃষ্টি। এ চরম প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ধ্বংসস্তূপে লাখো গৃহহীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে রাত যাপন করছেন। তুরস্কের বন্দরনগরী ইস্কেন্দেরুনে দেখা যায়, বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসস্তূপের ওপর অনেকেই আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করছেন।

তুরস্কের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, দেশটিতে ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, এমন মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখের বেশি। আর সিরিয়ায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক এল-মোস্তাফা বেনলামিল জানিয়েছেন, দেশটিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ কোটির বেশি মানুষ।

তুরস্ক থেকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাংবাদিক জানিয়েছেন, সেখানে রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে থাকছে। যাঁদের গাড়ি আছে, কিন্তু বাড়ি ধসে গেছে, তাঁরা গাড়ির মধ্যে রাত যাপন করছেন। অধিকাংশ গৃহহীন মানুষ চার রাত ধরে খোলা আকাশের নিচে রয়েছেন। আবার অনেকের বাড়ি অক্ষত থাকলেও নতুন করে ভূমিকম্পের আতঙ্কে বাড়িতে থাকছেন না। কেউ কেউ সুপারমার্কেটের পার্কিংয়ের স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে মসজিদে, রাস্তার পাশে থাকছেন। তাঁরা সবাই খাবার, সুপেয় পানি ও জ্বালানিসংকটে পড়েছেন। খাবার, নিরাপদ আশ্রয় ও একটু উষ্ণতার জন্য অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন তাঁরা। তুরস্কের ইজমির প্রদেশে ত্রাণের জন্য এমন অসংখ্য মানুষকে গতকাল ছুটতে দেখা যায়।

তুরস্কে গৃহহীনদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করছে সরকার। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। দেশটিতে যত হোটেল রয়েছে, তাতে মোট ১০ হাজার কক্ষ রয়েছে। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা থেকে এসব হোটেলে পৌঁছানোও বেশ ঝক্কির। গতকাল তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, হোটেলে ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

ত্রাণ ও আশ্রয় না পেয়ে অনেকে গতকাল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। উদ্ধারকাজে ধীরগতিতে হতাশা প্রকাশ করেছেন অনেক নিখোঁজের স্বজন। সিরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত আলেপ্পো প্রদেশের জানদারিস শহরে এ নিয়ে রয়টার্সের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয় ইব্রাহিম খলিল নামের একজনের সঙ্গে। তিনি বলেন, পরিবারের সাত সদস্যকে হারিয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে তাঁর স্ত্রী ও দুই ভাইও রয়েছেন। মরদেহ নেওয়ার জন্য একটি ব্যাগ ছিল খলিলের হাতে। সেই ব্যাগ দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘উদ্ধারকারীরা আমার স্বজনদের মরদেহ বের করে আনবে, এই অপেক্ষায় আছি। অবস্থা খুবই খারাপ। কোনো ত্রাণ বা সাহায্য এখানে পাওয়া যাচ্ছে না।’

তুরস্কেও এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলছেন, উদ্ধারকারীদের কাছে যথেষ্টসংখ্যক সরঞ্জাম নেই। ফলে উদ্ধারকাজে গতি নেই। অনেক শহরে পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। পানি সরবরাহ ব্যাহত হওয়ায় ও পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

মানবিক পরিস্থিতিতে গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের এখন বাঁচিয়ে রাখাই ত্রাণ সরবরাহকারী সংগঠনগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই ভয়ংকর ও খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন। হিমাঙ্কের নিচে রাত যাপন করতে হচ্ছে গৃহহীনদের।

ত্রাণ পৌঁছেছে সিরিয়ায়

ভূমিকম্পের কারণে সিরিয়ায় বেশি ভুগছেন বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর মানুষ। একদিকে বিদ্রোহীদের হামলার আশঙ্কায় মানুষের হাতে ত্রাণ পৌঁছানো কঠিন পড়েছে, অন্যদিকে ভূমিকম্পে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করেছে। তবে এর মধ্যেও গতকাল সেখানে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছেছে জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল। তুরস্কের সীমান্ত পেরিয়ে সেখানে গেছে তারা।

সিরিয়ায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় ঘাটতির জন্য গত বুধবার দায় স্বীকার করেছে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার। জাতিসংঘে সিরিয়ার রাষ্ট্রদূত বাসাম সাব্বাগ বলেছেন, উদ্ধারকাজ চালানোর মতো সরঞ্জাম সরকারের কাছে নেই। গৃহযুদ্ধ ও পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাকেও এ জন্য দায়ী করেছে দেশটি।

তবে দায় চাপালেও বাশার আল-আসাদের তৎপরতা চোখে পড়েনি। ভূমিকম্পের পর তিনি মন্ত্রীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন। কিন্তু কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি কিংবা জাতির উদ্দেশে ভাষণও দেননি।

ছাড়িয়ে গেল ২৪ বছর আগের মৃতের সংখ্যা

১৯৯৯ সালে তুরস্কের ইজমির ও ইস্তাম্বুলের পূর্ব মারমারা উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমিকম্পে ১৭ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি হয়। এবার সিরিয়া ও তুরস্কের সীমান্তে ভূমিকম্পে সেই সংখ্যা ছাড়িয়ে গেল। সোমবার ভূমিকম্পের পর যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভের (ইউএসজিএস) বিজ্ঞানীরা একটি মডেল দাঁড় করিয়ে বলেছিলেন, ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে, এমন আশঙ্কা ৪৭ শতাংশ। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি সেই আশঙ্কার চেয়ে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে।