মনের মানুষের মরদেহ দেখতে না পাওয়া তাড়িয়ে বেড়াবে তাঁদের

অং সান সু চি পার্লামেন্টের বৈঠকে যাচ্ছেন। সঙ্গে ফিয়ো জেয়া থ। ২০১৬ সাল
 ছবি: রয়টার্স

‘আমি তারা দেখতে পছন্দ করি। ও এটা খুব ভালো করেই জানত। এখন এই আকাশই আমাদের যোগাযোগের মাধ্যম।’ থাজিন নাইউন্ত অং ৩ জুনের কথা বলতে গিয়ে বলেন, সেদিন রাতে তিনি জানতে পারেন, তাঁর হবু বর ফিয়ো জেয়া থর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। জানুয়ারিতে তাঁর সাজা হয়।

গত সোমবার মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক খবরে দেশটির সাধারণ মানুষসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ স্তম্ভিত হয়ে যায়। খবরে আসে, নৃশংস ও অমানবিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দেওয়ায় দেশটির গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী ও শান্তিতে নোবেলজয়ী অং সান সু চির দলের সাবেক আইনপ্রণেতা ফিয়ো জেয়া থ, স্বনামধন্য এক অধিকারকর্মীসহ চার কারাবন্দীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে দেশটির জান্তা। তবে কখন ও কীভাবে এসব মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো, তা সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেনি রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার। তাঁদের মধ্যে দুজনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি।

অথচ কয়েক সপ্তাহ আগেও থাজিন ভেবেছিলেন, হয়তো এই সাজা কার্যকর হবে না। কারণ, গত তিন দশকের বেশি সময়ে মিয়ানমারে কোনো মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি।

মিয়ানমারে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় অং সান সু চিসহ অনেক শীর্ষ নেতাকে। অভ্যুত্থানের পর দেশজুড়ে রক্তাক্ত বিক্ষোভ শুরু হয়। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়। পরে ১২০-এর বেশি জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁদের মধ্যে ফিয়ো জেয়া থ একজন।

ফিয়ো জেয়া থ এই বিক্ষোভের ঘটনার ৯ মাস পর গত নভেম্বরে গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে জান্তা বাহিনীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলার পরিকল্পনা করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে গত বছরের আগস্টে ইয়াঙ্গুনে একটি কমিউটার ট্রেনে বন্দুক হামলার ঘটনাটিও আছে। ওই হামলায় পাঁচ পুলিশ সদস্য নিহত হন।

সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) সাবেক আইনপ্রণেতা ফিয়ো জেয়া থ ছিলেন সু চির খুব ঘনিষ্ঠ। ২০১৫ থেকে ২০ সাল পর্যন্ত সু চি দেশের বাইরে যত সফর করেছেন, তার প্রায় সব কটিতেই সঙ্গী ছিলেন ফিয়ো। গত জানুয়ারিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

কিন্তু এই অভ্যুত্থানের আগেই ফিয়ো জেয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচনে লড়বেন না। কারণ, তিনি তাঁর আবেগের জায়গায় ফিরে যেতে চেয়েছিলেন। আর তা হলো র‌্যাপিং। ফিয়ো জেয়ার বাগদত্তা থাজিন নাইউন্ত অং বলেন, ‘সে গান লিখতে চেয়েছিল, আবার মঞ্চে গাইতে চেয়েছিল। শিল্পী হিসেবে আমাদের অনেক স্বপ্ন ছিল। প্রতিটি মানুষের অনেক স্বপ্ন ও লক্ষ্য ছিল, কিন্তু এই অভ্যুত্থানে সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। বিক্ষোভাকারীদের গ্রেপ্তার করা হলো, কারাগারে পাঠানো হলো এবং হত্যা করা হলো।’

হিপ-হপ গ্রুপ এসিআইডির সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে ফিয়ো জেয়া থ জাতীয় খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ২০০০ সালে প্রতিষ্ঠিত গ্রুপটি মিয়ানমারের প্রথম দিককার হিপ-হপ গ্রুপগুলোর একটি।

যখন থাজিন জেয়া থর মৃত্যুদণ্ডের কথা জানতে পারেন, তাঁর চোখ ভিজে আসে, শরীর কাঁপতে থাকে। খুব ঠান্ডা লাগছিল তাঁর। তিনি সেফ হাউস থেকে বের হয়ে অজনা গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করেন। নিজের মনকে শান্ত করতে আকাশের দিয়ে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে থাকেন।

গ্রুপটির প্রথম অ্যালবাম ‘সা তিন জিইন’, যার অর্থ শুরু। এমন রক্ষণশীল একটি দেশে প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে কয়েক মাস ধরে অ্যালবামটি মিউজিক চার্টের শীর্ষে ছিল। তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক থান শোয়ের শাসনে হতাশ যুবকদের মধ্যে এই গান বেশ সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু ফিয়ো জেয়া থ দেশের জন্য আরও বেশি কিছু করতে চেয়েছিলেন।

২০০৭ সালে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বিক্ষোভের পর তিনি স্কুলজীবনের তিন বন্ধুকে নিয়ে প্রজন্মের ঢেউ নামে তরুণদের একটি গ্রুপ তৈরি করেন। গ্রুপটি গণতন্ত্রপন্থী গ্রাফিতি স্প্রে করত এবং বার্তাসহ স্টিকার, প্যামফলেট বিতরণ করত। কিন্তু তাদের দ্রুত নিষিদ্ধ করা হয় এবং ফিয়ো জেয়া থকে ২০০৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন বছর পর সাধারণ ক্ষমার আওতায় তিনি মুক্তি পান।

ইয়াঙ্গুনে সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারীদের বিক্ষোভ। ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

ফিয়ো জেয়া থর বন্ধু ও প্রজন্মের ঢেউয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা মিন ইয়ান নাইং বলেন, ফিয়ো জেয়া থ শুরু থেকেই সামরিক স্বৈরশাসন ও অন্যায়কে ঘৃণা করতেন। এই স্বৈরশাসনের ইতি ঘটবে, এটি তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন। যেকোনো সময় তাঁর বিপদ এলে তার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি।

ফিয়ো জেয়া থর মনোবল বর্ণনা করতে গিয়ে মিন ইয়ান বলেন, ‘জান্তারা সব সময় মানুষকে আতঙ্কিত ও ভয় দেখাতে চাইত। বরাবরের মতো মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার পরও ফিয়ো নির্বিকারই থেকেছে। হয়তো ভেতরে-ভেতরে সে কিছু অনুভব করেছে, কিন্তু জান্তাকে তা ভুলেও দেখায়নি। এই হলো জেয়া থ।’

২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর দমন-পীড়ন অনেক গণতন্ত্রপন্থী কর্মীর জন্য ছিল নির্মম। ফিয়ো জেয়া থর বান্ধবী থাজিন আতঙ্কে ইয়াঙ্গুনে নিজেদের বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন। এখনো সেখানেই আছেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফেসবুক ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি। কারণ, বারবার ফেসবুক ফিডে সামরিক বাহিনীর হাতে বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার ও নৃশংসতার ঘটনাগুলো তাঁর সামনে চলে আসে।

যখন থাজিন জেয়া থর মৃত্যুদণ্ডের কথা জানতে পারেন, তাঁর চোখ ভিজে আসে, শরীর কাঁপতে থাকে। খুব ঠান্ডা লাগছিল তাঁর। তিনি সেফ হাউস থেকে বের হয়ে অজনা গন্তব্যে হাঁটতে শুরু করেন। নিজের মনকে শান্ত করতে আকাশের দিয়ে তাকিয়ে প্রার্থনা করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাকে আমার ভালোবাসা পাঠিয়ে বলি, হাল ছেড়ো না। আমরা কিছুতেই পিছপা হব না, শেষ পর্যন্ত লড়ব।’

কারাগার ছিল যাঁর দ্বিতীয় বাড়ি

আন্দোলনকর্মী কিয়াউ মিন ইউ, যিনি কো জিমি নামে পরিচিত, তাঁর কাছে কারাজীবন নতুন কিছু ছিল না। ৫৩ বছর বয়সের মধ্যে দুই দশকের বেশি সময় কাটিয়েছেন গরাদের ওপাশে। বলা হতো, কারাগারই তাঁর ‘দ্বিতীয় বাড়ি’। ১৯৮৯ সালে গ্রেপ্তার হয়ে ২০ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

২০১২ সালে কারাগার থেকে দুজনের বের হওয়ার পর পুনর্মিলন

গত বছরের আগস্টে কো জিমি আবার গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, তিনি সামরিক তথ্যদাতাকে হত্যা এবং রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ভবন ও পাওয়ার স্টেশনে হামলার মূল হোতা ছিলেন।

১৯৮৮ সালে তৎকালীন স্বৈরশাসক নে উইনের ২৬ বছরের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের সময় কো জিমি ছাত্রনেতা। এর জেরে পরের বছর যেতে হয় কারাগারে। সেখানে বসে প্রায়ই মনে পড়ত হাইস্কুলের সাদা-সবুজ পোশাকের এক কিশোরীকে।

২০১৪ সালে এনপিআর রেডিওকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কো জিমি বলেছিলেন, তিনি কারাগারে যাওয়ার ছয় বছর পর সেই কিশোরী নিলার থেইন তত দিনে তরুণী। তাঁকেও বিক্ষোভ সংগঠিত করার দায়ে একই কারাগারে পাঠানো হয়। কো জিমি তখন নিলারকে চিঠি লিখতে শুরু করেন এবং তাঁদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। যদিও কারাগারে সেটা সম্ভব ছিল না।

২০০৪ সালে দুজনই কারাগার থেকে বের হন। তত দিনে কো জিমি ১৫ বছর ও ওই তরুণী ৮ বছর কারাবন্দী অবস্থায় কাটিয়ে ফেলেছেন। তবে এরপর তাঁরা দ্রুতই বিয়েটা সেরে ফেলেন। তিন বছরের মধ্যে এই দম্পতি আরেকটি বিপ্লবের নেতৃত্বের স্থানে চলে আসেন। ২০০৭ সালে মিয়ানমার ‘জাফরান বিপ্লব’-এ যখন জেগে ওঠে, তখন এই দম্পতি নেতৃত্ব দিতে শুরু করেন।

কো জিমি যখন গ্রেপ্তার হন, তখন তাঁদের মেয়ে মাত্র কয়েক মাসের। নিলার তাৎক্ষণিক আত্মগোপনে চলে যান। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে পালিয়ে বেড়ান। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। তিনিও গ্রেপ্তার হলেন। তবে তত দিনে তিনি মেয়েকে পরিবারের জিম্মায় রেখে যেতে পেরেছিলেন। ২০১২ সালে জেল থেকে দুজনই ছাড়া পান।

যতক্ষণ না জিমির মরদেহ দেখব...আমি কোনো আচার-অনুষ্ঠান পালন করব না।
নিলার থেইন

‘৮৮ প্রজন্ম’-এর এক নেতা মিন জেয়া বলেন, ‘বিপ্লবের তিন দশক ধরে জিমি কারাগারে ও কারাগারের বাইরে সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। আমাদের সবাইকে নির্ভীক মনোভাব নিয়ে সেই পরিস্থিতিগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে।’

সর্বশেষ যখন বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করা হলো, তখন অনেকেই মনে করেছেন, জান্তারা এসব অধিকারকর্মীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে না। কারণ জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে।

মিন জেয়া বলেন, ‘১৯৮৮ সালে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরোধিতা করায় অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমিও তাঁদের অনেকের সঙ্গে কারাগারে থেকেছি। কিন্তু কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি এবং অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার খবরটি খুবই বেদনাদায়ক। কারণ, জান্তা কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার অধিকারকর্মী ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে শুক্রবার ভার্চ্যুয়াল বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এমনকি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র আসন্ন মৃত্যুদণ্ডের গুজব অস্বীকার করে বলেছিলেন যে তাঁরা এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করবে না।

এদিকে স্বামীহারা নিলার থেইন নিরাপত্তা শঙ্কায় এ নিয়ে বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। কিন্তু প্রতিদিনই তিনি ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন, স্বামীকে ছাড়া কীভাবে তাঁর দিনগুলো কাটছে।

গত সোমবার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার খবরটি ছড়িয়ে পড়লে তিনি ভেঙে পড়েন। তিনি ফেসবুকে লিখেন, ‘হে আমার ভালোবাসা, দয়া করে বেঁচে থাকো। আমাদের বিপ্লব অবশ্যই জয়ী হবে, তুমি ইনসেইন কারাগারে আছো।’ কয়েক ঘণ্টা পর তিনি আরেকটি পোস্ট দেন। লিখেন, ‘যতক্ষণ না জিমির মরদেহ দেখব...আমি কোনো আচার-অনুষ্ঠান পালন করব না।’

মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া চারজনের মরদেহ দাহ করা হয়েছে কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে জান্তার হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো নিলার থেইন ও থাজিন নাইউন্ত অং যে তাঁদের ভালোবাসার মানুষদের শেষ দেখাও দেখতে পাবেন না, সেই কষ্ট তাড়া করে বেড়াবে শেষ পর্যন্ত।