তুরস্কের সানলিউরফা শহরের উত্তরের একটি সড়কে সারি সারি গাড়ি। এসব গাড়িতে করে আতঙ্কগ্রস্ত বাসিন্দাদের ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। সড়কের অন্য পাশে দেখা গেল প্রচণ্ড ঠান্ডায় বৃষ্টির মধ্যে অসহায় একটি পরিবার হেঁটে যাচ্ছে। সঙ্গে মালামালবোঝাই একটি ট্রলার। গতকাল সোমবার ভূমিকম্পের পর নিরাপদে রাত কাটানোর জন্য তারা আশ্রয় খুঁজছিলেন।
সানলিউরফা হলো তুরস্কের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের একটি বড় শহর। গতকাল ভোরে তুরস্ক ও সিরিয়ায় আঘাত হানা শক্তিশালী ভূমিকম্পে শহরটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ভূমিকম্পে ১০টি প্রদেশের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ভবন ধসে পড়েছে। আহত হয়েছে ১১ হাজারের বেশি মানুষ। ধ্বংসস্তূপের নিচে কতজন চাপা পড়ে আছে, তা এখনো অজানা।
সানলিউরফায় ভূমিকম্পে গুঁড়িয়ে যাওয়া একটি সাততলা ভবনে আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছেন কয়েকজন উদ্ধারকর্মী। সেখানে বন্ধুকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন ২০ বছর বয়সী সিরীয় শিক্ষার্থী ওমর এল চুনিদ। তিনি বলেন, ‘আমি জানি, এখানে ধ্বংসস্তূপের নিচে একটি পরিবার চাপা পড়ে আছে। বেলা ১১টা এবং দুপুরেও আমার বন্ধু তার মুঠোফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে। কিন্তু এখন আর তার সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি এখানে চাপা পড়ে আছে।’
এরপরও বন্ধুকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আশা জিইয়ে রেখে এ শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার মনে হয়, ওর ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেছে।’
ওমরের সামনেই পড়ে আছে একটি সোফার ধ্বংসাবশেষ, একটি ভাঙা চেয়ার এবং কিছু ছেঁড়া পর্দা। এখানকার বাসিন্দাদের সাদাসিধে জীবনের প্রতীক হয়ে আছে এগুলো।
বড় বড় কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে সরিয়ে মানুষের প্রাণের অস্তিত্ব খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন কয়েকজন উদ্ধারকর্মী। ক্লান্তি আর কষ্টের মধ্যেও জীবিত মানুষদের উদ্ধারের আশা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁরা।
ওমর বলেন, বৃষ্টি কিংবা ঠান্ডা যা–ই থাকুক না কেন, তিনি ও তাঁর বন্ধুরা সারা রাত সেখানে কাটাবেন। তিনি জোর গলায় বলেন, ‘আমাকে থাকতেই হবে।’
একটু সামনে এগোতেই দেখা গেল এমিন কাচমাজ নামের এক ব্যক্তি তাঁর আসবাবপত্রের দোকানের সামনে তিন বিক্রয়কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে আগুন পোহাচ্ছেন। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানটিতে যেন চুরি না হয়, তা নিশ্চিত করতে পাহারা দিচ্ছিলেন তাঁরা।
ভূমিকম্পে দোকানের বড় বড় জানালা ভেঙে গেছে। বড় বড় স্তম্ভে ফাটল দেখা গেছে। ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত সাততলা ভবনটির অবস্থা এখন খুবই নড়বড়ে।
৩০ বছর বয়সী কাচমাজ বলেন, ‘ভবনটি এখন আর নিরাপদ নয়।’ তারপরও দোকান ফেলে চলে যেতে রাজি নন তিনি।
কাচমাজ বলেন, ‘আমরা সারা রাত এখানেই থাকব। এটা আমাদের জীবিকা।’
কয়েক শ মিটার দূরে একই অ্যাভিনিউর একটি পার্কিং লটে একটি সাদা গাড়িতে বসে ছিলেন মোস্তফা কোয়ুনচু। সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান। তাঁরা সেখান থেকে কোথাও সরছেন না।
ভূমিকম্পের পর নিরাপত্তার কথা ভেবে সবাইকে সড়কে অবস্থানের নির্দেশ দিয়েছে তুরস্ক সরকার। সে প্রসঙ্গ টেনে কোয়ুনচু বলেন, ‘আমরা বাড়ি ফিরতে পারছি না, তাই এখানে অপেক্ষা করছি। এ মুহূর্তে বাড়ি ফেরা নিষেধ।’
তবে রাতের মধ্যে বাড়ি ফিরতে না পারলে সবাইকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী মসজিদে থাকতে হবে। ভূমিকম্পের পর অসহায় মানুষের অনেকে ওই মসজিদে আশ্রয় নিয়েছেন।
কোয়ুনচু বলেন, ‘আমাদের ভবন নিরাপদ আছে।’
তবে তাঁর বড় মেয়ে তা মানতে রাজি নন। তিনি বলে ওঠে, ‘না, তিনি এ ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত নন।’ এর পরপরই বাবা কোয়ুনচুর আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠও দুর্বল হয়ে আসে। কারণ, তিনি জানেন, পরিস্থিতির কারণে কেউই আতঙ্ক এড়াতে পারছে না। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেকেই আতঙ্কে আছে।’