ইরানে মাসার মৃত্যুর প্রতিবাদ

ক্ষোভের বার্তা কাগজে ছাপিয়ে প্রচার

ইরানের বিক্ষোভের প্রতি সংহতি জানাতে এসে দুই তরুণী কেঁদে ফেলেন। গত শনিবার স্পেনের মাদ্রিদে।
ছবি : এএফপি

ইরানে দমন–পীড়নের মাধ্যমে সরকার চাইছে বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠ রোধ করতে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অনলাইন কার্যক্রম, ইন্টারনেট। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা দমে যাননি। তাঁরা কাগজে বার্তা ছাপিয়ে মানুষের দোরগোড়ায় রাতারাতি পৌঁছে দিচ্ছেন। এভাবেই ইরানের আরও এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভ। খবর দ্য গার্ডিয়ানের

ইরানের তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। ‘অনুপযুক্ত পোশাক’ পরিধান ও ঠিকমতো হিজাব না পরার অভিযোগে গত ১৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী তেহরানে মাসাকে গ্রেপ্তার করে ইরানের ‘নীতি পুলিশ’। তিন দিন সংজ্ঞাহীন থাকার পর হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। পুলিশি নির্যাতনে মাসার মৃত্যু হয়েছে বলে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হলেও ইরানের কর্তৃপক্ষ বলছে, হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তরুণী মাসা।

আন্দোলনের আহ্বান জানিয়ে কাগজে লেখা বার্তাগুলোতে নানা কথা লেখা হচ্ছে। গতকাল রাশত শহরে এমনই একটি বার্তায় বলা হয়, ‘ইসলামিক রিপাবলিকের পতন হচ্ছে। জনগণের সঙ্গে যোগ দিন।’ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের পক্ষ থেকে বিক্ষোভের সময় ও স্থান জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া কাগজে লেখা বার্তায় পাঠকদের বলা হচ্ছে, ‘আপনি যদি আসতে না–ও পারেন, তাহলে অন্যদের কাছে এ বার্তা পৌঁছে দিন।’ বিক্ষোভ আয়োজনকারীদের পক্ষ থেকে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে রাস্তায় নারীদের নাচতে দেখা যায়। এ সময় তাঁদের হিজার পরা ছিল না। হিজাব হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছেন অনেকেই। এ সময় রাস্তায় দাঁড়ানো অনেকেই করতালি দিয়ে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মাসার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানে দুই সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে। বর্তমানে ইরানে বিক্ষোভ যে মাত্রায় ছড়িয়েছে এবং এতে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়তে দেখে তেহরান কর্তৃপক্ষের মনে ভয় ঢুকে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। অন্তত বিক্ষোভ দমনে সরকারের চেষ্টা সে কথায় মনে করিয়ে দিচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। এ ছাড়া বিক্ষোভকারীদের কঠোরভাবে দমনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। তেহরানে দাঙ্গা পুলিশ দিয়ে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিক্ষোভ দমনে এই কঠোরতার কারণে অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। মানবাধিকার সংস্থাগুলো ও ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বলছে, নিহতের সংখ্যা ৪০ থেকে ৮৩ জনের মতো হতে পারে। এ ছাড়া ১ হাজার ৫০০ বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করেছে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। ইরানে বিক্ষোভে তারকামহলের সমর্থন বন্ধ করার প্রচেষ্টা দেখা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকজন তারকাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

ইতিমধ্যে বিক্ষোভকারীদের ভয় দেখানোর পাশাপাশি বিক্ষোভে বাধা দেওয়ার নানা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে দমে যাননি বিক্ষোভকারীরা। তেহরানের নিগার নামের এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘জমায়েত নিয়ে অনলাইনে কিছু দেখে আপনি সেখানে যাবেন। কিন্তু সেখান থেকে আপনি জীবিত ফিরবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। ডিজিটাল যুগ শুরুর আগে এ রকম এক বিদ্রোহে বর্তমান শাসকেরা ক্ষমতায় এসেছিলেন। এখন কী করতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত জনগণ নিয়ে নিয়েছে।’

যেসব এলাকায় রাস্তাঘাট বিপজ্জনক, সেখানে মানুষ বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছেন। কেউ কেউ সরকারি নিয়ন্ত্রণকে পাশ কাটাতে ভিপিএন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছেন।

ইরানের এই বিক্ষোভের সূত্রপাত মূলত অনলাইনে। ইরানি ও বিদেশি তারকারা মাসার মৃত্যু ঘিরে টুইট করেন এবং হ্যাশট্যাগ দিয়ে সমর্থন জানান। ইতিমধ্যে বিক্ষোভকারীদের প্রতি সংহতি জানিয়েছে বিশ্বের ১৫৯ শহরে সমবেত হয়েছেন প্রবাসী ইরানি নাগরিক ও সমর্থকেরা।

ইরানের এই বিক্ষোভের প্রকৃতপক্ষে কোনো নেতা নেই। এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরাই। পুরুষেরা তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া ৪০ বছর বয়সী নারী নিগার বলেন, ‘আমি শুরুতে কিছুটা ভীত ছিলাম। কিন্তু যখন আমার মতো অনেককেই পথে নামতে দেখলাম, তখন আমিও সাহস পেয়ে এগিয়ে এসেছি।’

গত শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে ফেরার সরকারি আদেশ অমান্য করেন। তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরা স্লোগান দেন, ‘বিচার, স্বাধীনতা ও ঐচ্ছিক হিজাব’। পরে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেন। ইসপাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভিডিওতে এক নারীকে হিজাব পোড়াতে দেখা যায়। মাশাদে শিক্ষার্থীদের বলতে শোনা যায়, প্রাণ গেলেও নিপীড়ন সহ্য করা হবে না।

তেহরানের এক বাসিন্দা বলেন, ‘সব সেনা মুখোশ পরে রয়েছে। যখন আমি বাইরে যাই মনে হয়, কোনো ভিডিও গেমের মধ্যে চলেছি। তারা মানুষজনকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে, যাতে তারা বিক্ষোভ করতে না পারে। কিন্তু জনগণ তাদের পাত্তা না দিয়ে বিভিন্ন স্থানে জড়ো হচ্ছে।’

শনিবার যেখানে বিক্ষোভ হয়েছে, সে জায়গা ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির বাসভবন থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তিনি বাইরে এলেই স্লোগান তাঁর কানে পৌঁছাবে।

নাওশীন নামের এক বিক্ষোভকারী বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেককে শেষ করে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাবে। তারা আমাদের দিকে সরাসরি কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়েছে। আমার চোখ জ্বালা করছে। চোখের পানি আর যন্ত্রণায় সারা রাত ঘুমাতে পারিনি।’