মালদ্বীপ ঘিরে ‘মহাসমর’

মালদ্বীপের আশপাশটা সমুদ্র পরিবহনের গুরুত্ববহ এলাকা। সে কারণে এখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে শক্তিধর অনেক দেশের প্রত্যাশার ভার বইতে হচ্ছে। বহির্বিশ্বে অনেকের কাছে জয়-পরাজয়ের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে মালদ্বীপের ভোট।

ইব্রাহিম সলিহ, ইয়ামিন গাইয়ুম ও মুহাম্মদ নাশিদ

ভূমি-আয়তন অনুযায়ী বিশ্বের দেশগুলোর তালিকা হলে মালদ্বীপ ২০৯তম হবে। ৩০০ বর্গকিলোমিটারের মতো শুকনো জায়গা আছে তার। কিন্তু ‘ঠান্ডাযুদ্ধে’র কালে এক ইঞ্চি জমিও বড় দেশগুলোর আগ্রহের বাইরে থাকার উপায় নেই।

মালদ্বীপের অবস্থাও তা–ই। আগামী ৯ সেপ্টেম্বর মালদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো দেখলে বোঝা যায়, এই নির্বাচন ঘিরে দেশটির রাজধানী মালের চেয়েও বেশি চাপা উত্তেজনা চলছে বেইজিং ও নয়াদিল্লিতে। এমনকি ওয়াশিংটনের বিভিন্ন দপ্তরেও।

যে নির্বাচনী গণতন্ত্র ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে

বাংলাদেশর মানুষের কাছে মালদ্বীপের পরিচিতি দুই রকমের। বেকারদের কাছে এটা কাজের খোঁজে যাওয়ার দেশ। এক লাখের বেশি বাংলাদেশি আছেন এখানে। আবার অতিধনী বাংলাদেশিদের মালদ্বীপ পছন্দ বেড়ানোর জায়গা হিসেবে। এর সাগর লাগোয়া মনোহর ‘ভিলা’গুলো বিলিয়নিয়ারদের কাছে খুব আকর্ষণীয়। শেষোক্তদের অনেকে জানেন, মালদ্বীপে নির্বাচনের সময় বড় রিসোর্টগুলোতেও ব্যালট বাক্স থাকে। আপাতদৃষ্টিতে যা উন্নত গণতন্ত্রের বার্তা দেয়।

বাস্তবে ১৯৬৫ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতার পর যে নির্বাচনী সংস্কৃতির শুরু, তা কোনোমতে এখনো ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছে মাত্র। মামুন আবদুল গাইয়ুমের তিন দশকের শাসনে (১৯৭৮-২০০৮) নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক বলাৎকার হয়। গত এক যুগে তা আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতামুখর হয়েছে কেবল।

‘গরিবের সুন্দরী বউ’য়ের দিকে নজর

মালদ্বীপে প্রেসিডেন্টকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা। ফলে আসন্ন নির্বাচনে একজন প্রেসিডেন্ট বেছে নিতে হবে ২ লাখ ৮০ হাজার ভোটারকে। ভোটারসংখ্যার হিসাবে মালদ্বীপের নির্বাচনকে বাংলাদেশের একটা সংসদীয় আসনের সমতুল্য ব্যাপার বলা যায়। ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব এ রকম ছোট নির্বাচনকে এশিয়ার প্রধান এক উত্তেজক বিষয়ে পরিণত করেছে।

বাংলায় ‘গরিবের সুন্দরী বউ’ বলে যে কথা চালু আছে, মালদ্বীপের অবস্থা সে রকম। চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া মিলে ঠান্ডাযুদ্ধ যত গরম করছে, ভারত মহাসাগরের জল তত ঘোলা হচ্ছে। সেই সূত্রে এই সাগরের মধ্যে থাকা মালদ্বীপের দিকে দূরদূরান্তের মোড়ল-মাতব্বরদেরও দৃষ্টি পড়ছে।

মালদ্বীপের আশপাশটা সমুদ্র পরিবহনের গুরুত্ববহ এলাকা। সে কারণে এখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে শক্তিধর অনেক দেশের প্রত্যাশার ভার বইতে হচ্ছে। বহির্বিশ্বে অনেকের কাছে জয়-পরাজয়ের উপলক্ষ হয়ে উঠেছে মালদ্বীপের ভোট।

এমডিপি ও পিপিএম উভয়ে ঝামেলায়

মালদ্বীপে বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সলিহ। ডাকনাম ইবু। তাঁকে ইবু সলিহও বলা হয়। সেপ্টেম্বরে তিনি ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হতে চান। ‘এমডিপি’ নামে পরিচিত এই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীপ বা ‘পিপিএম’। পিপিএম থেকে স্বাভাবিকভাবে তাদের নেতা ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের প্রার্থী হওয়ার কথা। ইয়ামিন গাইয়ুম হলেন মালদ্বীপের পুরোনো শাসক মামুন আবদুল গাইয়ুমের বয়সে ছোট সৎভাই।

তাঁদের পিতা আবদুল গাইয়ুম ইব্রাহিমের (তাঁর আট স্ত্রী ছিলেন) ২৫ সন্তানের মধ্যে মামুন ছিলেন ১১তম এবং ইয়ামিনের চেয়ে ২০ বছর বড়। প্রভাবশালী পরিবার এরা। মামুন ও ইয়ামিন মিলেই পিপিএমের গোড়াপত্তন করেন। তবে বহু আগে ইয়ামিনের ইচ্ছায় মামুন গাইয়ুমকে পিপিএম ছাড়তে হয়। দুর্নীতির অভিযোগে ইয়ামিনেরও ১১ বছর সাজা হয়েছে। নির্বাচনের আগে আগে এ রকম মামলা ও রায়ে পিপিএম বিচার বিভাগে সলিহ সরকারের প্রভাব দেখছে।

এই অভিযোগ কতটা সত্য, তা যাচাই সহজ নয়। তবে ইয়ামিনের বিরুদ্ধে দেওয়া নিম্ন আদালতের রায় এখনো উচ্চ আদালতে চূড়ান্ত হয়নি। ফলে তিনি নির্বাচন করতে পারবেন কি না, সেটা অনিশ্চিত। তাঁর প্রার্থিতা অনিশ্চিত হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে এমডিপি ও সলিহের সুবিধা হওয়ার কথা। কিন্তু মুশকিল হলো সলিহের দলের ভেতর আবার উপদলীয় সংঘাত বেধেছে। এই দলের প্রভাবশালী নেতা মুহাম্মদ নাশিদও প্রেসিডেন্ট হতে চান। তিনি এখন ‘মজলিশ’ নামে পরিচিত পার্লামেন্টের স্পিকার। একসময় তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন এ দেশে। নাশিদের অনুসারীরা কিছুদিন আগে এমডিপি ছেড়ে নতুন দল বানিয়েছেন ‘দ্য ডেমোক্র্যাটস’ নামে। শাসক দলের ১২ জন এমপি এ দলে যোগ দিয়েছেন। নাশিদ ইতিমধ্যে এই দলে যোগ দিয়েছেন।

এমডিপি ভেঙে দুই উপদল হওয়া এবং তা থেকে দুজনের প্রেসিডেন্ট হতে চাওয়া সংগত কারণে বিরোধী দল পিপিএমের জন্য সুখকর। কিন্তু সেই সুখ তারা উপভোগ করতে পারছে না, যেহেতু তাদের প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। ইয়ামিনের দণ্ড তাদের বেকায়দায় ফেলেছে। অথচ ব্যাপক জনসমর্থন আছে এই দলের।

প্রশ্ন হলো, মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির এ রকম অবস্থার সঙ্গে ভূরাজনীতি কীভাবে সম্পর্কিত?

বিশ্বের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে অন্যতম অবকাশযাপনের জায়গা মালদ্বীপ

রাজনীতিতে যখন শেষ কথা বলে কিছু নেই!

আবদুল্লাহ ইয়ামিন যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন চীনের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য ছিল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে তাঁর পরাজয় এবং সলিহের ক্ষমতায় আসা ভারতের প্রচারমাধ্যমকে বেশ উৎসাহের সঙ্গে প্রচার করতে দেখা যায়।

নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারকেরা সচরাচর মনে করেন, ভারত মহাসাগরে প্রভাববলয় তৈরির স্বাভাবিক অধিকার আছে তাঁদের দেশের এবং সে লক্ষ্যে মালদ্বীপ কাছে থাকাই সংগত। তা ছাড়া অতীতে দেশটির নানান বিপদে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। ১৯৮৮ সালের নভেম্বরে তামিল ভাড়াটে সৈনিকদের এক অভ্যুত্থানের হাত থেকে মালদ্বীপের সরকারকে রক্ষা করেছিল ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘অপারেশন ক্যাকটাস’। ভারত এসব সহায়তার বিনিময়ে মালদ্বীপের কাছে স্থায়ী আনুগত্য প্রত্যাশা করে বলে মালদ্বীপের অনেকের অনুমান।

অন্যদিকে চীন মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বিশ্বশক্তি হতে গিয়ে ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপ তার বন্ধুদেশ হলে ভালো হয়। দেশটিকে বন্ধু বানাতে ইয়ামিনের আমলে তারা নানান অবকাঠামো তৈরিতে বেশুমার ঋণ-অনুদান দিয়েছে। সরকারি হিসাবে চীনকে পরিশোধ করতে হবে এমন ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার। চীনের জন্য মধুর ক্ষণ ছিল ওই ঋণ দেওয়ার সময়টা এবং ইয়ামিনের ১১ বছর কারাদণ্ডের ঘটনায় স্বভাবত হতোদ্যম তারা। আবার এমডিপিতে দুটি উপদল তৈরি হওয়ায় নয়াদিল্লিও আসন্ন নির্বাচন নিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারছে না।

মালদ্বীপের রাজনীতির এই জটিলতায় চীন-ভারতের নেতাদের পাশাপাশি দেশটির মানুষও হতবিহ্বল।

ইতিমধ্যে এমডিপির নাশিদপন্থী উপদল তাদের ঐতিহাসিক বিরোধী পক্ষ পিপিএমের ইয়ামিন অনুসারীদের সঙ্গে জোট করার জন্য যোগাযোগ করেছে। অর্থাৎ বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহের পুনরায় ফিরে আসা ঠেকাতে পুরোনো বৈরিতা ভুলে সব বিরোধী দলের সঙ্গে এক কাতারে দাঁড়াতে চায় তারা। রাজনীতি যে সব সম্ভবের শিল্পকলা, সেটাই প্রমাণিত হয় এতে। অথচ নাশিদ ও সলিহ শৈশবের বন্ধু এবং শেষোক্তজনের স্ত্রী ফাজনা আহমেদের সূত্রে উভয়ে তাঁরা নিকটাত্মীয়।

সলিহকে ক্ষমতায় আনায় নাশিদের সহায়তা ছিল। অন্যদিকে নাশিদ ও ইয়ামিনের রাজনৈতিক শত্রুতা অনেক পুরোনো। কিন্তু এসব এখন ইতিহাসমাত্র। নাশিদের কাছে আপাতত প্রধান বিষয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে সলিহকে ঠেকানো। অতীতের শত্রু পিপিএমের সঙ্গে হাত মেলাতেও প্রস্তুত তিনি। তবে পিপিএম এখনো বলছে না তাদের প্রধান ইয়ামিন প্রার্থী না হলে তারা নির্বাচনে কাকে প্রার্থী করবে বা কাকে সমর্থন করবে? রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে, পিপিএম যদি শেষ পর্যন্ত নাশিদকে সহায়তা করে, তাহলে সলিহের পক্ষে জিতে আসা কঠিন। প্রশ্ন হলো, তাতে ইয়ামিনের অনুসারীদের কী লাভ হবে? কিংবা নাশিদ প্রেসিডেন্ট হলে ভারতের দিক থেকে অসুবিধা কী? চীনের দিক থেকে লাভ কী?

‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ বনাম ‘ইন্ডিয়া আউট’

প্রেসিডেন্ট সলিহের শাসনামলে মালদ্বীপের সমাজের একটা নজরকাড়া ঘটনা হলো ‘ইন্ডিয়া আউট’ নামের প্রচার আন্দোলন। ২০২০ সালে এটা শুরু। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, সলিহ সরকার দেশের মাটিতে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি তৈরি করেছে। মাঠপর্যায়ের এই আন্দোলন ততটা শক্তি পায়নি, যতটা হইচই ফেলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।

২০২১ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট সলিহ এক ডিক্রি জারি করে এই আন্দোলন থামান। এই আন্দোলনের প্রতি বিরোধী দল পিপিএমের উৎসাহ গোপন ছিল না। সে কারণেই আন্দোলন শুরুর পর থেকে ভারতে পিপিএম এবং ইয়ামিন নিন্দার শিকার হতে থাকেন। কিন্তু এমডিপি থেকে বের হয়ে আসা মুহাম্মদ নাশিদ প্রেসিডেন্ট হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে এখন ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীলদের কাছে যাচ্ছেন।

ব্যক্তিগতভাবে তিনি এ রকম আন্দোলনের পক্ষের কেউ নন, বরং উল্টোটাই সত্য। একাধিকবার প্রকাশ্যে সলিহ সরকারের ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ নীতির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন নাশিদ। কিন্তু নির্বাচন সামনে আসায় সবার রাজনৈতিক আদর্শের কিছুটা ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে। এত দিনের বিরোধী পক্ষ পিপিএমের সহায়তায় নাশিদ যদি প্রেসিডেন্ট হন, তাতে মাঠপর্যায়ে ভারতবিরোধী সামাজিক শক্তির জয় হিসেবেই দেখতে হবে একে। ও রকম অবস্থায় ইয়ামিনের পক্ষেও কারাদণ্ড পাল্টিয়ে আবার রাজনীতিতে ফেরার পথ খুলতে পারে।

ইয়ামিন নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারলে যেকোনো মূল্যে এমডিপির সলিহকে হারাতে চাইবেন, তাতে সন্দেহ নেই। আর সলিহের পরাজয় ভারতের স্বার্থের দিক থেকে হবে একটা আঘাত। গত কয়েক বছর সলিহকে তারা নানাভাবে সহায়তা করেছে। দেশটিতে তাদের অনেক কৌশলগত অর্জনও রয়েছে সম্প্রতি।

২০২৩-২৪–এর বাজেটে ভারত মালদ্বীপের জন্য ৪০০ কোটি রুপি রেখেছে ঋণ হিসেবে। সেই ঋণের অর্থে তারা মে মাসে দেশটির নৌবাহিনীকে দুটি যুদ্ধযান দিয়েছে। এর আগে ২০২২ সালে মালদ্বীপের উপকূলজুড়ে ১০টি রাডার বসিয়েছে। তার আগের বছর ছোট্ট এই দেশে ভারত তার দ্বিতীয় কূটনৈতিক মিশন খুলেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ভারত এখানে হাইড্রোগ্রাফিক সার্ভেরও কাজ করছে। এত সব সুযোগ করে দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট সলিহকে দুষছেন বিরোধীরা। আসন্ন ভোটে এ রকম সব পক্ষ যদি একত্র হতে পারে, সেটা বেইজিংয়ের পক্ষে যাবে।

আবার পিপিএম যদি ইয়ামিনকে প্রার্থী করতে ব্যর্থ হয় এবং নাশিদকে সমর্থন না দিয়ে নিজ দলের ভেতর অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়, তাহলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট সলিহের জয়ের সম্ভাবনাই বেশি। অর্থাৎ ইয়ামিনবিহীন ত্রিমুখী নির্বাচন সলিহকে জেতাবে; দ্বিমুখী নির্বাচন নাশিদকে লাভবান করবে।

যুক্তরাষ্ট্রও মালদ্বীপকে পাশে চায়

নির্বাচন ঘিরে ভূরাজনৈতিক বিবেচনার বাইরে ভিন্ন আরেক সামাজিক শঙ্কা উঁকি দিচ্ছে মালদ্বীপে। গত এক দশক এখানে উদারনৈতিক ভাবাধারার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করছে অনেক সামাজিক সংগঠন। স্থানীয়দের দক্ষিণপন্থী মনস্তত্ত্বের দিকে টানছে তারা।

দেশটির নির্বাচনী রাজনীতিতে চীন-ভারতের প্রভাব খুঁজতে সবাই যখন ব্যস্ত, ঠিক ওই ফাঁকে সেখানে বাড়ছে রক্ষণশীল তৃতীয় পক্ষ। মধ্যপ্রাচ্যের ‘আইএস’ নামে পরিচিত ইসলামিক স্টেট যোদ্ধাদলে মালদ্বীপের প্রায় আড়াই শ নাগরিক আছে বলে আল-জাজিরায় খবর বের হয়েছিল একদা (৮ মে ২০২১)। দেশটিতে ইতিমধ্যে একাধিক সাংবাদিক উগ্রপন্থীদের দ্বারা অপহৃত বা খুন হয়েছেন। এসব নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা নিয়মিত উদ্বেগ প্রকাশ করে যাচ্ছে। আইএসের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা আহমেদ আমিন যে মালদ্বীপের মানুষ, সে দাবিও আছে যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে।

তবে আইএস শনাক্ত করার বাইরেও মালদ্বীপ নিয়ে ওয়াশিংটনের আগ্রহ আছে। ২০২০ সাল থেকে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক উপস্থিতি বাড়ছে। ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর দুই দেশ একটা প্রতিরক্ষা চুক্তিও সই করেছে। ভারতের বাইরে এই প্রথম কোনো দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করার সাহস দেখাল মালে।

বলা বাহুল্য, নয়াদিল্লির অনুমোদন ছিল এতে। অথচ ২০১৩ সালে মালদ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘সোফা’ (স্ট্যাটাস অব ফোর্সেস অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি করতে চাইলে ভারত বাদ সেধেছিল। ঠান্ডাযুদ্ধ মাত্র ছয়-সাত বছরে এ অঞ্চলে সম্পর্কের সমীকরণ অনেক বদলে দিয়েছে, সেটাই প্রমাণিত হয় এ ঘটনায়।

তবে ওয়াশিংটন মালদ্বীপের সঙ্গে কেবল প্রতিরক্ষা চুক্তি করেই থামতে চায় না। ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায়’ মালদ্বীপকে ‘আরও পাশে’ চায়। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়ামিনের আমলে দেশটি চীনের বিআরআইয়ের (বেল্ট অ্যান্ড রোডস ইনিশিয়েটিভ) সাগরভিত্তিক রুটে যুক্ত হওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে।

চীনাদের বিআরআই যে ওয়াশিংটনের পছন্দ নয়, সেটা কোনো গোপন ব্যাপার নয়। ফলে যুক্তরাষ্ট্র সামনের নির্বাচনে ইয়ামিন বা পিপিএমকে হয়তো আর দেখতে চাইবে না। এখানে ওয়াশিংটন ও নয়াদিল্লির পছন্দ মিলছে, কিন্তু এমডিপি দলে ভাঙন উভয়ের যৌথ পছন্দের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে।

পুনশ্চ:

ঠান্ডাযুদ্ধের সময় রাজনীতির মতো কূটনীতিও নাটকীয়ভাবে পাল্টাচ্ছে। ভারত ১৯৮৮ সালে মালেতে যে অভ্যুত্থান দমন করে, তার অন্যতম সংগঠক ছিলেন আজকের প্রেসিডেন্ট সলিহের স্ত্রীর পিতা আহমেদ ইসমাইল মালিক। আর এখন সলিহ সেখানে তাঁদের প্রধান পছন্দ।

  • আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক।