জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে ১৯৫৬ সালে আণবিক বোমার আঘাতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া কিছু মানুষ আণবিক ও হাইড্রোজেন বোমার ভুক্তভোগীদের সংগঠন নিহন হিদানকায়ো গঠন করেছিলেন। হিরোশিমা-নাগাসাকিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া ভুক্তভোগীদের দুর্দশা যে কতটা গভীর, জাপানের বাইরের লোকজন তা নিয়ে তখন পর্যন্ত খুব বেশি অবগত ছিলেন না।
বিশ্ব সে সময় স্নায়ুযুদ্ধের দুই শিবিরে বিভক্ত ছিল। এ কারণে বোমার ক্ষয়ক্ষতি নিয়েও দুই পক্ষের মধ্যে বিভাজন বজায় ছিল। ফলে হিরোশিমা–নাগাসাকিতে ঠিক কী ঘটেছিল আর বিকিরণের প্রভাব কতটা বিস্তৃত ছিল, তা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা সংবাদমাধ্যম কিংবা বিভিন্ন নাগরিক গোষ্ঠীর সমাবেশ হতে দেখা যায়নি।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামালার পর প্রথম মাসে নিহত হওয়ার সম্মিলিত সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিকিরণের সংস্পর্শে আসা অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন।
তবে তা সত্ত্বেও ভুক্তভোগীরা বসে থাকেননি। বরং প্রতিকূল পরিস্থিতিতে স্রোতের বিপরীতে নিজেদের যাত্রা অব্যাহত রেখে পরমাণু অস্ত্রের ভয়াবহতার বার্তা বিশ্বজুড়ে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে, বিশেষ করে পশ্চিমা বিশ্বের শাসকদের পাশাপাশি সেসব দেশের সংবাদমাধ্যম এদের শুধু সোভিয়েত ইউনিয়নের দোসর আখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি। একই সঙ্গে চেষ্টা করে গেছে তাদের বার্তা যেন ব্যাপক প্রচার না পায়। এর পেছনের কারণ ছিল আণবিক বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতি এবং হামলার পরোক্ষ প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রধান দুই পরাশক্তির ভিন্ন অবস্থান।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে বোমা হামালার পর প্রথম মাসে নিহত হওয়ার সম্মিলিত সংখ্যা দুই লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে বিকিরণের সংস্পর্শে আসা অনেকেই প্রাণ হারিয়েছেন। আণবিক বোমা হামলার দুই দশক পরও যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছিল যে নতুন উদ্ভাবিত সেই অস্ত্র ব্যবহার না করলে যুদ্ধে প্রাণহানির সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারত।
ফলে আণবিক বোমা হামলাকে প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে জুতসই এক পথ হিসেবেই দেখছিল মার্কিন নেতৃত্ব। তাদের দেওয়া সেই ব্যাখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন নাগরিকও বিশ্বাস করেছিলেন। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির ধারণায় তাদের আস্থার কথা বললেও পরমাণু অস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করার পদক্ষেপ থেকে কখনো সরে আসেনি। এ কারণে তাদের মিত্র হিসেবে পরিচিত বিশ্বের অন্যান্য দেশও নিজ নিজ পক্ষের নেতাদের মতোই অবস্থান নেয়।
অন্যদিকে জাপানে আণবিক বোমা হামলার পর পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির আহ্বান জানাতে বেশ কিছু নাগরিক সংগঠন দেশজুড়ে প্রচারণা চালায়। কিন্তু জাপান সরকার একধরনের নীরবতা বজায় রাখায় তাদের পক্ষে খুব বেশি অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি। তবে পরবর্তী সময়ে হিবাকুশা বা আণবিক বোমা হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া লোকজনের মঞ্চে আবির্ভাব পরিস্থিতি ক্রমশ পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছিল। নিজেদের দুর্দশার কথাই কেবল বলা নয়। একই সঙ্গে কতটা গভীর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে এবং এর প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধিদের ওপর কতটা ফেলছে। সেই বর্ণনা তুলে ধরার মধ্যে দিয়ে ধীরে হলেও তারা নাগরিক সহানুভূতি অর্জন করতে পেরেছিলেন। নিহন হিদানকায়ো ছাড়াও বেশ কয়েকটি সংগঠন এ ধরনের প্রচার অভিযানের নেতৃত্বে ছিল।
নিহন হিদানকায়োর এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ অনেকটাই হচ্ছে সময়োচিত। কারণ, ইতিমধ্যে অধিকাংশ হিকাকুশার মৃত্যু হয়েছে। যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, এই স্বীকৃতি তাঁদের জন্য নিয়ে এসেছে তৃপ্তির অনুভূতি।
নিহন হিদানকায়োর সদস্যরা দেশজুড়ে প্রচার অভিযান চালিয়েই থেমে থাকেননি। একই সঙ্গে হিবাকুশাদের জন্য চিকিৎসাসুবিধা বাড়াতে সরকারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে গেছে। ফলে হিবাকুশাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসুবিধা বেড়েছে। পরবর্তী প্রজন্মের যে সদস্যরা বিকিরণ–সংক্রান্ত অসুখে আক্রান্ত বলে চিহ্নিত হচ্ছেন, তাঁরাও এখন সেই সুবিধা ভোগ করতে পারছেন। তবে তা সত্ত্বেও তাদের প্রতি একধরনের পরোক্ষ নেতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন থেকে জাপান এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আণবিক বোমা হামলার ক্ষয়ক্ষতির স্বীকৃতি এসেছে অনেক পরে। শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের অস্বীকৃতি এবং হামলার যৌক্তিকতা তুলে ধরে ব্যাপক প্রচার চালানো হয়। ফলে মার্কিন নাগরিকদের মধ্যেও আণবিক বোমা হামলা নিয়ে এ রকম ভ্রান্ত ধারণার জন্ম দিয়েছিল যে হামলার ক্ষয়ক্ষতির ওপর উদ্দেশ্যমূলকভাবে অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে।
এ কারণে জাপানের হিবাকুশাদের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা ১৯৭০–এর দশক থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন সমাবেশ আয়োজন করে নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির আহ্বান জানাতে জনমত গড়ে তোলায় অবদান রাখতে শুরু করেন। যুক্তরাষ্ট্রে এদের অনেককে কেবল বিরোধিতার মুখোমুখি নয়, বৈরী পরিস্থিতির মুখেও পড়তে হয়েছিল। তবে হিবাকুশারা কখনোই হাল ছেড়ে দেননি।
বোমা হামলার মর্মান্তিকতা সম্পর্কে অনেকে সচেতন থাকলেও ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপ্তি সম্পর্কে অজ্ঞ থাকায় পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির আন্দোলন ব্যাহত হয়েছে। সেই বিভ্রান্তি দূর করে নিতে হিবাকুশা ও তাঁদের বিভিন্ন সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছে।
নিহন হিদানকায়োর সদস্যরা দেশজুড়ে প্রচারাভিযান চালিয়েই থেমে থাকেননি। একই সঙ্গে হিবাকুশাদের জন্য চিকিৎসা–সুবিধা বাড়াতে সরকারকে নানাভাবে চাপ দিয়ে গেছে। ফলশ্রুতিতে হিবাকুশাদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা–সুবিধা বেড়েছে।
তাঁদের অনেকে বয়সের ভারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। তবে যাঁরা এখনো সক্রিয় আছেন, তাঁরা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। ফলে নিহন হিদানকিওর এ বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ অনেকটাই হচ্ছে সময়োচিত। কারণ, ইতিমধ্যে অধিকাংশ হিকাকুশার মৃত্যু হয়েছে। যাঁরা এখনো বেঁচে আছেন, এই স্বীকৃতি তাঁদের জন্য নিয়ে এসেছে তৃপ্তির অনুভূতি। যে লক্ষ্য নিয়ে তাঁরা গত প্রায় আট দশক ধরে কাজ করে গেছেন, পরমাণু অস্ত্র বিলুপ্তির সেই লক্ষ্য এখনো অধরা থেকে গেছে। শান্তির নোবেল পুরস্কার যে বার্তা নিয়ে আসছে তা হলো, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ সেই লক্ষ্য পূরণ হওয়া দেখতে আগ্রহী।
এ কারণে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পর এক সংবাদ সম্মেলনে নিহন হিদানকায়োর প্রধান তোশিইয়ুকি মিমাকি বলেছেন, তিনি ও সংগঠন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের কথা কখনো ভাবেনি। একই সঙ্গে বলেছেন যে, ‘জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তি একসঙ্গে স্বাক্ষর করা। যুদ্ধ এবং পরমাণু অস্ত্র মুক্ত একটি বিশ্ব আমাদের অবশ্যই গড়ে নিতে হবে।’
জাপানে আণবিক বোমা হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যাওয়া মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার। তাঁদের গড় বয়স ৮৫ বছর। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে তাঁরা সবাই যে হারিয়ে যাবেন, সেটা হচ্ছে বাস্তবতা। তাই তাঁদের অনুপস্থিতে হিরোশিমা-নাগাসাকির বার্তা বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ যেন থেমে না থাকে, নিহন হিদানকায়ো সে জন্য বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই হিবাকুশাদের নিজের মুখে দেওয়া বর্ণনা ধারণ করে রাখছে। পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মকেও তাঁদের শুরু করে যাওয়া কাজের সঙ্গে যুক্ত করতে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ফলে বলা যায় পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে হিবাকুশা ও অন্যদের চালানো আন্দোলনকে নোবেল পুরস্কার কেবল অনুপ্রাণিতই করবে না, একই সঙ্গে আন্দোলনকে আরও বেগবান করে তুলবে।
তবে বিশ্বের শক্তিধর বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতাদের বিবেককে এটা কতটা জাগ্রত করবে তা নিয়ে সন্দেহ। কারণ, অস্ত্রের উৎপাদন ও ব্যবসা যেভাবে সর্বগ্রাসী আকার করেছে। তাতে নিজের প্রতিরক্ষার দোহাই দিয়ে উল্টো পথের সেই প্রতিযোগিতায় সামিল হয়ে যুদ্ধ প্রস্তুতির অবস্থান তাঁরা সবাই ধরে রাখবেন। গাজার পরিণতি, লেবাননের দুরবস্থা এবং ইউক্রেনে চলতে থাকা যুদ্ধ সে রকম পরোক্ষ ইঙ্গিতই আমাদের দিচ্ছে। তারপরও এ কারণে আমরা আশাবাদী যে নিহন হিদানকিওর মত সংগঠন আমাদের জাগ্রত রাখতে এখনো নিরলস কাজ করে চলেছে।