তাইওয়ানের প্রত্যন্ত পূর্ব উপকূলীয় কাউন্টি হুয়ালিয়েনে গতকাল বুধবার যখন ৭ দশমিক ২ তীব্রতার ভূমিকম্প আঘাত হানে, তখন স্থানীয় কর্মকর্তা চ্যাং তুং-ইয়া ঠিক জানতেন কী করতে হবে। কারণ, এই অভিজ্ঞতা তাঁর ছয় বছর আগেও হয়েছিল।
সকাল আটটার ঠিক আগমুহূর্তে ভূমিকম্প আঘাত হানে। কিন্তু এর দুই ঘণ্টার মধ্যে যেন সব স্বাভাবিক। লোকজন সবাই কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়েন। চ্যাং বলেন, স্কুলের কাছেই একটি জরুরি আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ১৩০ জনের বেশি বাসিন্দা রাত কাটান।
২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ানে আঘাত হানা সবচেয়ে শক্তিশালী এই ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল ছিল হুয়ালিয়েন শহরের ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণে। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্যমতে, ভূমিকম্পের তীব্রতা ছিল ৭ দশমিক ৪।
তাইওয়ানের স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত কর্মকর্তা চ্যাং রয়টার্সকে বলেন, সরকারি বিভাগের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করাটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসহায়তা কার্যক্রমে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সরকারি ইউনিট ও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় জোরদার করে।
এবার কাউন্টি কর্মকর্তারা ও পুলিশ অন্যান্য ইউনিটের সঙ্গে মিলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় হেলে পড়া একটি ভবন থেকে আটকে পড়া বাসিন্দাদের দ্রুত উদ্ধার করে। কারণ, ভূমিকম্প-পরবর্তী পরাঘাতে ভবনটি ধসে পড়লে তাঁদের মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল।
তাইওয়ানে ভূমিকম্প নতুন কিছু নয়। এই দ্বীপাঞ্চলের অবস্থান দুটি টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলের কাছে। অঞ্চলটি পর্যটকদের জন্য একটি বড় আকর্ষণস্থল।
তাইওয়ানের দক্ষিণাঞ্চলে ২০১৬ সালে ভূমিকম্পে শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে আঘাত হেনেছিল ৬ দশমিক ৪ তীব্রতার ভূমিকম্প। ওই সময় সাতজন নিহত হয়েছিলেন। আর ১৯৯৯ সালে ৭ দশমিক ৩ তীব্রতার ভূমিকম্পে ২ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হন।
১৯৯৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বরের ভূমিকম্প ‘৯২১ কম্পন’ নামে পরিচিত। ওই ভূমিকম্পের পর সরকার সতর্ক হয়। তারা দেশটির ইমারত বিধিমালা (বিল্ডিং কোড) সংশোধন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন শক্তিশালী করার ওপর জোর দেন।
এই তারিখ এখন দেশটিতে ‘দুর্যোগ মহড়া দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। এই দিনে ভূমিকম্প ও সুনামির মতো দুর্যোগ হয়েছে, এমনটা জানিয়ে মানুষের মুঠোফোনে প্রতীকী সতর্কতামূলক খুদে বার্তা পাঠানো হয়। পাশাপাশি স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নেওয়ার মহড়াও দেওয়া হয়।
তাইওয়ানের আলফা সেফ প্রতিষ্ঠানটি ভবন তৈরিতে যেসব উপকরণ ব্যবহৃত হয়, সেগুলো ভূমিকম্পসহনশীল করে তুলতে কাজ করে। প্রতিষ্ঠানটির মালিক ইয়েত তাই ইয়ন ফা বলেন, কঠোর ইমারত বিধি দ্বীপটিকে বিপর্যয় মোকাবিলায় আরও ভালোভাবে প্রস্তুত হতে সাহায্য করেছে, এটা ঠিক। তারপরও কিছু আবাসন ব্যবসায়ী এখনো নীতিমালা সঠিকভাবে মেনে চলেন না।
তাই-ইয়ন বলেন, ‘যখন কম দামে পণ্য পাওয়াটাই মূল লক্ষ্য হয়, তখন আপনি আর সেরা মানের পণ্য পাবেন না।’
হুয়ালিয়েনের দ্য মাস্টার্ড সিড মিশনের কাউন্টি ব্রাঞ্চের উপপরিচালক দোনা ও বলেন, ২০১৮ সালের উদ্ধার তৎপরতায় বেশ বিশৃঙ্খলা ছিল। সেখান থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। দোনা বলেন, তখন সবাই একই কাজ করছিলেন। কোনো সমন্বয় ছিল না। কিন্তু এবার প্রতিটি গ্রুপ পৃথকভাবে কাজ করেছে।
দুর্যোগ মোকাবিলায় তাইওয়ানের নিজেকে প্রস্তুত রাখার আরেকটি আবশ্যিক কারণ রয়েছে। সেটি হলো, চীনের তরফ থেকে আক্রমণের আশঙ্কা। কারণ, চীন তাইওয়ানকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে। তারা বেইজিংয়ের সার্বভৌমত্বের দাবি মেনে নিতে তাইওয়ানের ওপর সামরিক ও রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়েছে।
আরও রয়েছে ভূমিকম্পের সতর্কতা হিসেবে মুঠোফোনে অ্যালার্ম বেজে ওঠার ব্যবস্থা। একইভাবে চীনের বিমান হামলা হলেও মুঠোফোনে এই সতর্কতার ব্যবস্থা রয়েছে।
তাইওয়ান বার্ষিক মিন’আন বেসামরিক প্রতিরক্ষা মহড়া চালায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মাথায় রেখেই এই মহড়ার আয়োজন করা হয়। তবে গত বছর এর সঙ্গে চীন হামলা চালালে কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সেই প্রশিক্ষণও যুক্ত হয়।
তাইওয়ানের শহর ও কাউন্টিতে ২৪ ঘণ্টা উদ্ধার সেবা রয়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো দুর্যোগে তারা কাজ করতে প্রস্তুত থাকে। উদাহরণস্বরূপ, ভূমিকম্পের এক ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কাউশিংয়ে স্থানীয় সরকার তাদের উদ্ধারকর্মীদের হুয়ালিয়েনে পাঠানোর জন্য একত্র করে পিংতুং বিমানঘাঁটিতে পাঠায়। সেখান থেকে তাঁদের বিমানবাহিনীর উড়োজাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
এসব উদ্ধারকর্মী নিয়মিত বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় উদ্ধারকাজে যান। তাইওয়ানে আমেরিকান ইনস্টিটিউটের (এআইটি) পরিচালক স্যান্ড্রা ওডকির্ক তাইওয়ানের উদ্ধারকাজের প্রশংসা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাইওয়ান বিশ্ববাসীর কাছে দুর্যোগ প্রতিরোধ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও মানবিক উদ্ধারকাজের একটি সফল মডেল দাঁড় করিয়েছে।