নেপালে কেন এত বেশি উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা

ইয়েতি এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি মাঝ আকাশেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল
ছবি: ভিডিওচিত্র থেকে নেওয়া

নেপালের প্রাণঘাতী উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় এখনো চার আরোহী নিখোঁজ। তাঁদের খোঁজে আজ সোমবার দ্বিতীয় দিনের মতো তল্লাশি শুরু করেছেন কয়েক শ উদ্ধারকর্মী। এই দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নেপালে আকাশপথে ভ্রমণের ঝুঁকির বিষয়টি আবারও সামনে এসেছে। দেশটিকে উড়োজাহাজ চলাচলের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়ে থাকে।

গতকাল রোববার পোখারা বিমানবন্দরের কাছে ইয়েতি এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয়। উড়োজাহাজের ৭২ আরোহীর ৬৮টি জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। বাকিদের কারও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।

এটি হিমালয়ের দেশটিতে ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা। এভিয়েশন সেফটি নেটওয়ার্কের তথ্যমতে, নেপালের ইতিহাসে এটি তৃতীয় মারাত্মক উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা।

নেপালের লুকলা শহরের বিমানবন্দরটিকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর বিমানবন্দর বলা হয়

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, দৃষ্টিসীমার সীমাবদ্ধতা এবং পাহাড়ি ভূগঠন—এসব কিছুই নেপালকে আকাশপথে যাত্রার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের কুখ্যাতি এনে দিয়েছে।

কন্ট্রোল টাওয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সময় ইয়েতি এয়ারলাইনসের কাঠমান্ডু থেকে পোখারার ফ্লাইটটি কিছুক্ষণ পরই অবতরণ করতে যাচ্ছিল। নেপালের বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, উড়োজাহাজটিতে ১৫ জন বিদেশি যাত্রী ছিলেন।

হ্রদের তীরবর্তী শহর পোখারা জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। শহরটি হিমালয়ের প্রবেশপথ হিসেবেও পরিচিত। বিখ্যাত অন্নপূর্ণা সার্কিট ট্র্যাকিং রুটের যাত্রা শুরু হয় এই শহর থেকেই। ২০১৯ সালে ১ লাখ ৮১ হাজারের বেশি বিদেশি পর্যটক এলাকাটি ভ্রমণ করেন।

ফরাসি কর্তৃপক্ষের সহায়তায় উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ তদন্ত করে দেখছে একটি সরকারি কমিটি। ইয়েতি এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজটি তৈরি করেছিল উড়োজাহাজ নির্মাতা কোম্পানি এটিআর। কোম্পানিটির সদর দপ্তর ফ্রান্সে।

২০১৮ সালে ঢাকা থেকে নেপালের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলার একটি উড়োজাহাজ কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হয়

‘বিরূপ ভূগঠন’

নেপালে উড়োজাহাজ চলাচলে শুধু দ্রুত পরিবর্তনশীল আবহাওয়াই একমাত্র সমস্যা নয়। দেশটির বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের ২০১৯ সালের সেফটি রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটির ‘বিরূপ ভূগঠনও’ এই সমস্যার একটি অংশ। আর এসব ‘ব্যাপক চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়তে হয় পাইলটদের।

নেপালের জনসংখ্যা ২ কোটি ৯০ লাখ। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ১৪টি পাহাড়ের মধ্যে এভারেস্টসহ ৮টিই দেশটিতে অবস্থিত। উঁচু–নিচু প্রাকৃতিক ভূদৃশ্যের সৌন্দর্য নেপালকে পর্বতারোহীদের জন্য জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত করেছে।

তবে এই পাহাড়ি ভূখণ্ডে, বিশেষ করে প্রতিকূল আবহাওয়ার সময় পথ ঠিক রেখে উড়োজাহাজ চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। দেশের অধিকতর দুর্গম ও পাহাড়ি অংশে প্রবেশের জন্য ছোট উড়োজাহাজ ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় বলে বিষয়গুলো আরও জটিল ঠেকে।

যেসব উড়োজাহাজে ১৯টি অথবা এর চেয়ে কম আসন থাকে, এসব চ্যালেঞ্জের কারণে সেগুলোর বেশি দুর্ঘটনায় পড়ার আশঙ্কা থাকে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়। রাজধানী কাঠমান্ডু নেপালের পরিবহনব্যবস্থার প্রাথমিক কেন্দ্র। এখন থেকেই অধিকাংশ ছোট উড়োজাহাজ চলাচল করে থাকে।

উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় নেপালের লুকলা শহরের বিমানবন্দরটিকে প্রায়ই বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর বিমানবন্দর বলা হয়। এটি এভারেস্টের প্রবেশদ্বার হিসেবেও পরিচিত। বিমানবন্দরটির রানওয়ে দুটি উঁচু পাহাড়ের ঢালে অবস্থিত। রানওয়েটি সোজাসুজি একটি গভীর খাদের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। এই বিমানবন্দরে ২০০৮ ও ২০১৯ সালসহ গত বছরগুলোয় একাধিক প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা ঘটে।

আকাশপথে এই ঝুঁকি আরও বাড়িয়েছে পুরোনো উড়োজাহাজ পরিচালনা থেকে সরে আসতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাব।

জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান পরিবহন সংগঠন (আইসিএও) তাদের এভিয়েশন সেফটি ইমপ্লিমেন্টেশন পার্টনারশিপের মাধ্যমে ২০১৫ সালে নেপালকে সহযোগিতার বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়।

নিরাপদ উড্ডয়নের উদ্বেগ নিরসনে দুই বছর পর আইসিএও এবং নেপাল অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কাজ করার ঘোষণা দেয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নিরাপদ উড্ডয়নের মানদণ্ডে উন্নতি করেছে দেশটি। তবে এখনো কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

গত বছরের মে মাসে তারা এয়ারের একটি উড়োজাহাজ পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয়। ওই দুর্ঘটনায় পোখারা থেকে জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা জমসন যাওয়ার পথে ২২ আরোহী নিহত হন। ‘টুইন ওটার’ উড়োজাহাজটির মতোই তারা এয়ারের আরেকটি উড়োজাহাজ একই পথে ২০১৬ সালে বিধ্বস্ত হয়েছিল।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের শুরুর দিকে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিমান অবতরণের সময় বিধ্বস্ত হলে আগুন ধরে যায়। এতে ৭১ আরোহীর ৫১ জনই নিহত হন।