২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। ২০২১ সালে তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে
২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। ২০২১ সালে তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে

২০ বছরের রক্তক্ষয়ের পর স্বপ্নভঙ্গ

২০২১ সালে বিশ্বের নানা প্রান্তে ঘটে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণ, পর্যবেক্ষণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করছে প্রথম আলো অনলাইন। এই আয়োজনের সপ্তম লেখাটি এখন প্রকাশিত হলো।

আশঙ্কাটা আগেই করা হচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত তা সত্য হলো।

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের মধ্যেই গত ১৫ আগস্ট তালেবানের ঝটিকা অভিযানের মুখে দেশটির রাজধানী কাবুলের পতন হয়। দেশ ছেড়ে পালান পশ্চিমা-সমর্থিত আফগান সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি।

অস্ত্র, হামলা, সহিংসতা, নৃশংসতা—এসবের ওপর ভর করে ২০ বছর পর আফগানিস্তানের ক্ষমতা আবার তালেবানের হাতে যায়।

আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের যতটুকু চর্চা শুরু হয়েছিল, নারীর ক্ষমতায়নের যে ধারার সূচনা হয়েছিল, তা তালেবানের ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে থমকে যায়। এ যেন ২০ বছরের পণ্ডশ্রম। ২০ বছর পেছনে ফিরে যাওয়া।

তালেবান দাবি করেছিল, ক্ষমতায় এলে তাদের আর আগের রূপে দেখা যাবে না। ২০০১ সালের তালেবান, আর ২০২১ সালের তালেবান এক হবে না।

কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। তালেবান আগের মতোই রয়ে গেছে। দ্বিতীয় দফায় আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসার পর এখন তাদের একের পর এক কট্টরনীতি ও নৃশংসতার তথ্য সামনে আসছে।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা। এ হামলার জেরে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নামে।

আল-কায়েদাকে আশ্রয়প্রশ্রয় দিচ্ছিল তৎকালীন তালেবান সরকার। তাই সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের শুরুতেই আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট। অল্প সময়ের মধ্যেই তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়।

ক্ষমতা থেকে তালেবান হটানোর পর আফগানিস্তান গঠনের নামে ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ চালিয়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত তারা আফগান জনগণের ভাগ্য সেই তালেবানের হাতেই ছেড়ে দিয়ে দেশটি ত্যাগ করে।

তালেবানের কঠোর শাসন তো আছেই, তার সঙ্গে আফগানে এখন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। তারা এখন দেশটিতে রক্তক্ষয়ী হামলা চালাচ্ছে।

২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাদের সমূলে উৎপাটন করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবাহিনী। বরং তারা রাশিয়া-পাকিস্তানের কাছ থেকে সহায়তা পেয়ে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে ওঠে বলে অভিযোগ আছে। ফলে তালেবান ধীরে ধীরে নিজেদের শক্তি ও দখল এলাকার পরিধি বাড়াতে সক্ষম হয়। একই সঙ্গে বাড়ে তাদের হামলা।

দুই দশকের আফগান যুদ্ধে লাখো মানুষ হতাহত হয়। তাদের মধ্যে বিদেশি ও আফগান বাহিনীর সদস্য আছেন। আছেন সাধারণ আফগান নাগরিক।

আফগানিস্তান গঠনে বিপুল অর্থ ব্যয় করে যুক্তরাষ্ট্র। এ খরচের পরিসংখ্যান মার্কিন সরকারের নথি থেকে পাওয়া যায়।

গত ৮ জুলাই হোয়াইট হাউসের প্রেসনোটে উল্লেখ করা হয়, আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ নানা সরঞ্জাম বাবদ যুক্তরাষ্ট্র এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে।

এ ছাড়া ২০০১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক ব্যয় হয় ৭৭ হাজার ৮০০ কোটি ডলার।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তরই যে শুধু আফগানিস্তানে অর্থ ব্যয় করেছে, তা নয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাসহ দেশটির বিভিন্ন সংস্থা আফগানিস্তানে অবকাঠামো নির্মাণে ব্যয় করে সাড়ে চার হাজার কোটি ডলার।

নারীদের ব্যাপারে তালেবানের চিন্তাচেতনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি

তবে যুক্তরাষ্ট্রের এ অর্থ অনেকটা জলেই গেছে। কারণ, শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দেশটির পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার অদক্ষতা ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল।

আফগান বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ পেলেও তারা তালেবানের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। বরং তারা অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করেছে। অনেক সেনা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়েছে।

পশ্চিমা ও আফগান বাহিনীর অস্ত্রশস্ত্র এখন তালেবানের হাতে। তারা সেসব অস্ত্রশস্ত্রের বলে আগের চেয়ে বেশি বলীয়ান।

২০ বছরের ব্যবধানে তালেবানের চিন্তাচেতনায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এ দফায় ক্ষমতায় এসেই তারা ঘোষণা করে, দেশ চলবে শরিয়া আইনে।

নারীদের নিয়ে আগে তালেবানের ভাবনা যেমন ছিল, এখনো তেমনটাই রয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেই তারা নারীবিষয়ক মন্ত্রণালয় বন্ধ করেছে। নারীদের বাইরে কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়েশিশুরা এখনো স্কুলে যেতে পারছে না।

ক্ষমতায় আসার পর তালেবানের শিক্ষামন্ত্রী শেখ মৌলভি নুরুল্লাহ মুনির বলেছিলেন, ‘এখনকার দিনে পিএইচডি ডিগ্রি, মাস্টার্স ডিগ্রির কোনো মূল্য নেই। আপনারা দেখুন, ক্ষমতায় থাকা মোল্লা ও তালেবান কারোরই পিএইচডি, এমএ, এমনকি হাইস্কুল ডিগ্রিও নেই। কিন্তু তারা সবার সেরা।’

যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি, আফগানিস্তানে যে উদ্দেশ্যে তারা এসেছিল, তা অর্জিত হয়ে গেছে। অর্থাৎ সন্ত্রাসের মূল উৎপাটিত হয়েছে। কিন্তু তালেবানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিসংগঠন আল-কায়েদার এখনো সখ্য থাকার অভিযোগ আছে। কাবুল দখলের পর তালেবানকে অভিনন্দন জানায় আল-কায়েদার ইয়েমেন শাখা।

তালেবান অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু তারা কথা রাখেনি।

শুধু তা-ই নয়, গত সেপ্টেম্বরে তালেবান যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেয়, তাতে জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের কালো তালিকায় থাকা একাধিক সদস্য রয়েছেন।

তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে এখন পর্যন্ত স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার বলছে যে এ স্বীকৃতির বিষয়টি নির্ভর করবে তালেবানের কর্মকাণ্ডে। তাদের কথায় নয়।

আন্তর্জাতিক মহলের কাছ থেকে এখনো স্বীকৃতি পায়নি তালেবান

কিন্তু এখন পর্যন্ত তালেবানের যে কর্মকাণ্ড দেখা যাচ্ছে, তা তাদের সেই পুরোনো শাসনামলের কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকদের অভিমত, তালেবান যদি তার বর্তমান নীতিতে অটল থাকে, তবে তাদের জন্য আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করাটা কঠিন হবে।

তালেবান ক্ষমতায় আসায় সাধারণ আফগান নাগরিকদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। নানামুখী সমস্যায় দেশটিতে মানবিক সংকট দেখা দিয়েছে। তারা ২০ বছর ধরে যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, যে স্বপ্ন দেখেছে, তার ফল কার্যত শূন্য।

তথ্যসূত্র: সিএনএন, নিউইয়র্ক টাইমস, এএফপি, এনডিটিভি, রয়টার্স