চীনের অধীনে থাকা হংকংয়ে ১২ সপ্তাহ ধরে বিক্ষোভ চলছে। ধীরে ধীরে সহিংস হয়ে উঠছে পরিস্থিতি। পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হচ্ছে। বিক্ষোভকারীদের গ্রেপ্তার করার পাশাপাশি পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়ছে, জলকামান ব্যবহার করছে। পরিস্থিতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে শিগগিরই কোনো সমাধানের আশা দেখা যাচ্ছে না।
এই বিক্ষোভের ক্ষেত্রে চীন শুরুর দিকে যেন নীরব থাকার নীতি নিয়েছিল। কিন্তু দিন যতই গড়িয়েছে, বিক্ষোভ যখন সহিংসতার দিকে এগিয়েছে, তখন বেইজিং এই বিক্ষোভে ‘পশ্চিমাদের মদদ’ রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে। দেশটির সামাজিক গণমাধ্যম ওয়েইবু, উইচ্যাটে বেইজিংয়ের পক্ষে নানা বার্তা ছড়াচ্ছে; এমনকি হংকংয়ের বিক্ষোভকারীদের মনে করিয়ে দেওয়া হচ্ছে চীনের শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কথাও। চীন সরকারও সরাসরি অভিযান চালানোর সতর্কবার্তা দিয়েছে।
বিক্ষোভের শুরু
বিক্ষোভের শুরুটা হয় প্রস্তাবিত নতুন প্রত্যর্পণ আইন নিয়ে। ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নতুন প্রত্যর্পণ আইন প্রণয়নে উদ্যোগী হয় হংকং। হংকংয়ের এক ব্যক্তি বান্ধবীকে নিয়ে ছুটি কাটাতে তাইওয়ানে যান। অভিযোগ উঠেছে, ওই ব্যক্তি তাইওয়ানে তাঁর অন্তঃসত্ত্বা বান্ধবীকে হত্যা করে হংকংয়ে পালিয়ে আসেন। কিন্তু হংকংয়ের সঙ্গে তাইওয়ানের প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই বলে ওই ব্যক্তিকে বিচারের জন্য সেখানে পাঠানো যাচ্ছে না। ফিন্যান্সিয়াল টাইমস বলেছে, ওই ব্যক্তি এখন হংকংয়ের কারাগারে আছেন। তিনি বান্ধবীকে হত্যার কথা স্বীকারও করেছেন।
প্রস্তাবিত ওই প্রত্যর্পণ আইন পাস হলে চীন, তাইওয়ান ও ম্যাকাওয়ে কোনো মামলায় অভিযুক্ত কাউকে প্রত্যর্পণের আহ্বান জানালে সেটা মানতে হবে হংকং কর্তৃপক্ষকে। এটাই হংকংয়ের জনগণের মধ্যেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাঁদের মতে, এ আইনের মাধ্যমে হংকংয়ের বিচারব্যবস্থাই হুমকির মুখে পড়বে। হংকংয়ের ওপর চীনের প্রভাব বাড়বে। হংকংয়ের যেকোনো ব্যক্তিকে শায়েস্তা করতে চীন এ আইন ব্যবহার করবে। তবে হংকং সরকার বলছে, আইনটিতে নাগরিকদের সুরক্ষার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। আইনের পক্ষে সরকারের যুক্তি হলো, এমন আইন না হলে হংকং পলাতক অপরাধীদের আখড়ায় পরিণত হবে।
আন্দোলনকারীদের দাবি
চলমান বিক্ষোভের মুখে প্রস্তাবিত ওই আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়া আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লাম ঘোষণা দেন, প্রত্যর্পণ বিলটি পাসের উদ্যোগ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এই স্থগিতের ঘোষণায় বিক্ষোভ স্তিমিত হয়নি। আন্দোলনকারীরা কয়েক দফা দাবি তুলে ধরে তা আদায়ের জন্য বিক্ষোভে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। মোটা দাগে আন্দোলনকারীদের দাবিগুলো বিবিসিতে তুলে ধরা হয়েছে—প্রত্যর্পণ বিল পুরোপুরি প্রত্যাহার করতে হবে, এই বিক্ষোভ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গ্রেপ্তার হওয়া সবাইকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনতে হবে, বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের নৃশংসতার নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে, সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ও লেজিসলেটিভ কাউন্সিল নির্বাচন দিতে হবে। বিক্ষোভকারীদের আবার কেউ কেউ এসব দাবির সঙ্গে হংকংয়ের প্রধান নির্বাহী ক্যারি লামের পদত্যাগ দাবি করছেন।
বিক্ষোভকারী ড্যানিয়েল বিবিসিকে বলেন, ‘আমাদের পূর্বপ্রজন্ম তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। তাই আমরা দাবি আদায়ের লড়াইয়ে নেমেছি। ১৫ থেকে ৩০ বছরের তরুণেরা এই আন্দোলন করছি। আমরা নিজেদের জন্য ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য এই আন্দোলনে শামিল হয়েছি।’
কী বলছে চীন
তবে হংকংবাসী যা–ই বলুক, নতুন প্রত্যর্পণ আইন জরুরি বলে মনে করছে চীন। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের এক প্রতিবেদনে হংকংয়ে বেইজিংয়ের লিয়াজোঁ অফিসের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৯৯৭ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত ২৬৬ সন্দেহভাজন অপরাধীকে চীনের মূল ভূখণ্ড থেকে হংকংয়ে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু হংকং থেকে একজনকেও চীনে নেওয়া হয়নি। তাই নতুন প্রত্যর্পণ আইন যত দ্রুত করা যায়, ততই ভালো—এমনটাই অবস্থান বেইজিংয়ের।
হংকংয়ের এই আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রের ‘কালো হাত রয়েছে’ বলে অভিযোগ তুলেছে চীন। চায়না ডেইলির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, হংকংয়ে মার্কিন কনস্যুলেটের কর্মকর্তা জুলি ইদাহ হংকংয়ের আন্দোলনকারী নেতা মার্টিন লি এবং আনসন চ্যানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বৈঠক করেছেন ২০১৪ সালে অবৈধ ‘অকুপাই সেন্ট্রাল’ আন্দোলনের নেতা জসুয়া অংয়ের সঙ্গেও। আন্দোলনকারীদের নেতাদের ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বৈঠকগুলোর ছবিও রয়েছে। এসব বৈঠকের মাধ্যমে হংকংয়ের বিক্ষোভের আগুনে ‘ঘি ঢালা’ হয়েছে।
এদিকে বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হংকংয়ে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে চীন। যদিও সুনির্দিষ্ট পরিস্থিতি ছাড়া হংকংয়ে সামরিক বাহিনী পাঠানোর এখতিয়ার চীনের নেই। সেই তিনটি বিষয় হলো: প্রথমত, যদি চীন পুরোপুরি জরুরি অবস্থা জারি করে কিংবা হংকংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে; দ্বিতীয়ত, যদি হংকং কর্তৃপক্ষ সেনা পাঠাতে চীন সরকারের কাছে অনুরোধ জানায় এবং তৃতীয়ত, জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ও দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনগণকে বাঁচাতে।
চীনের সেনা পাঠানোর হুমকির বিষয়ে বিক্ষোভকারী তরুণ ক্রিস বলেন, ‘চীন সেনা পাঠালে ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো হবে। কোনো দেশ আমাদের বাঁচাতে সহায়তা করবে না। কিন্তু হংকংয়ের জনগণ ওই লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।’ আরেক বিক্ষোভকারী ড্যানিয়েল বলেন, ‘এই লড়াইয়ে আমরাই জিতব। কারণ চীনের অর্থনীতি আমাদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের পুড়িয়ে ফেলা হলে ওদের (চীন) নিয়েই পুড়ে মরব।’
চীন-হংকংয়ের সম্পর্ক
চীন সাগরে অবস্থিত ৪২৪ বর্গমাইলের দ্বীপ হংকং ব্রিটিশ উপনিবেশ ছিল। ১৯৯৭ সালে এটি চীনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অনেক ক্ষেত্রেই চীনের মূল ভূখণ্ডের চেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে হংকং। হংকংয়ের নিজস্ব বিচার বিভাগ ও আইনি ব্যবস্থা রয়েছে, যা চীনের সঙ্গে মেলে না। হংকংয়ে যে মাত্রায় বাক্স্বাধীনতা ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা রয়েছে, তা চীনে নেই। তাই বলা হয়, চীনের অধীনে ‘এক দেশ, দুই নীতিতে’ চলা ভূখণ্ড হংকং। তবে হংকং এই সুবিধাগুলো ভোগ করবে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত। এরপর কী হবে—সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা নেই।
এদিকে বিক্ষোভকারীদের প্রতি নতুন করে সতর্কবার্তা দিয়েছে চীন। মঙ্গলবার চীনের জননিরাপত্তাবিষয়ক মন্ত্রী চাও কেঝি বলেছেন, ‘সহিংস সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ বন্ধে হংকংয়ে অভিযান চালাবে চীন। যদিও কখন-কীভাবে এই অভিযান চালানো হবে, তা সুনির্দিষ্টভাবে বলেননি তিনি।
এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), কানাডা, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। ফ্রান্সে অনুষ্ঠিত জি-৭ সম্মেলনেও হংকং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো। ওই সম্মেলন শেষে যৌথ বিবৃতিতে হংকং নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে চীন। যা–ই হোক, ১৯৯৭ সালে চীনের অধীনে আসার পর হংকংয়ে এটাই সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ; যেখানে বহির্বিশ্বেরও সহানুভূতি আছে আন্দোলনকারীদের প্রতি। এখন বেইজিং কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেয়, সেটাই দেখার বিষয়।