শান্ত চেহারায় বসে ছিলেন তিনি। চুলে গোঁজা ছিল তাজা ফুল। আপাত সুস্থির চিত্তে শুনছিলেন বিরোধীপক্ষের অভিযোগ। সেই অভিযোগে বলা হচ্ছিল গণহত্যার কথা। জানানো হচ্ছিল, ছোট শিশুদের আগুনে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার খবর। নারীদের গণধর্ষণের ঘটনাও বাদ পড়েনি।
নির্বিকার মুখে এসব অভিযোগ শুনছিলেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাকটো নেতা অং সান সু চি। একসময় ‘নিপীড়িতের কণ্ঠস্বর’ উপাধি পেয়েছিলেন তিনি। সেই সু চি নৃশংস অভিযোগের জবাবে বলে বসলেন, সব মিথ্যা। নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক নিলেন নিপীড়কের পক্ষ। শান্তির পায়রা ওড়ানোর বদলে শাসক জান্তার অস্ত্রের ঝনঝনানিতেই আস্থা রাখলেন সু চি।
এ নিয়ে ইকোনমিস্ট, গার্ডিয়ান, বিবিসি, সিএনএন, ফরেন পলিসি, ডিপ্লোম্যাটসহ বিভিন্ন মূল ধারার আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে উঠেছে নিন্দার ঝড়। বলা হচ্ছে, সামরিক জান্তার বিশ্বাসভাজন হতে এবং ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সুবিধা পেতে সু চি নিজের অতীতের সুনাম বিসর্জন দিয়েছেন। এর সুফলও তিনি হাতেনাতে পেয়েছেন। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ নাকচ করার পরপরই মিয়ানমারজুড়ে সু চির সমর্থনে মিছিল হয়েছে। বহুত্ববাদী ধারণার গলা টিপে কট্টর জাতীয়তাবাদী রূপে দেখা দিয়েছেন সু চি।
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মঙ্গলবার থেকে অনুষ্ঠিত হয় তিন দিনের শুনানি। সেখানে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অং সান সু চি যেভাবে গণহত্যার অভিযোগকে এককথায় খারিজ করে দিলেন, তা নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে চলছে তুমুল সমালোচনা। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে দেওয়া সু চির বক্তব্য প্রমাণ করে যে, রোহিঙ্গাদের জন্য তাঁর কোনো প্রকার সহানুভূতি অবশিষ্ট নেই। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও তাঁর চিন্তা–ভাবনায় তফাত নেই বললেই চলে।
দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে বাদীপক্ষ গাম্বিয়া ও মিয়ানমার তাদের বক্তব্য দিয়েছে। অভিযোগের শুনানিতে গাম্বিয়া রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগের বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রমাণও দাখিল করেছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রামাণ্যচিত্র ও নথিপত্রও দাখিল করা হয়েছে। তবে মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি নিজেদের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, তাঁর দেশের সেনাসদস্যরা যুদ্ধাপরাধ করে থাকলে তা মিয়ানমারের দেশীয় তদন্ত ও বিচারব্যবস্থায় নিষ্পত্তি করা হবে। এটিকে আন্তর্জাতিকীকরণের সুযোগ নেই। তাঁর দাবি, ১৯৪৮-এর গণহত্যা সনদ এখানে প্রযোজ্য নয়।
ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট–এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে যে সু চি ১৫ বছর অন্তরীণ ছিলেন, তিনিই এখন সামরিক বাহিনীর সুরে তাল মেলাচ্ছেন। আর তাঁর এই রূপান্তর বিস্ময়কর। দ্য হেগে নিজের যাওয়ার বিষয়টি সু চি খুব ভেবেচিন্তেই ফলাও করে প্রচার করেছেন। এর পেছনে আছে মিয়ানমারের স্থানীয় রাজনীতিতে ফায়দা লোটার স্বার্থ। আর তাতেই অন্ধ হয়ে নিজের এত দিনের সম্মানজনক ভাবমূর্তিতে কাদা লেপতেও কাঁপছে না সু চির হাত।
বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালের নির্বাচনে জিতে সু চির নেতৃত্বাধীন বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেও, তাতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কমেনি। বরং এখনো মিয়ানমারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সে দেশের সামরিক বাহিনী। পার্লামেন্টেও তাদের অংশীদারত্ব আছে। আছে প্রতিরক্ষা, স্বরাষ্ট্র ও সীমান্তসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ। এমন পরিস্থিতিতে দেশটির নেতা অং সান সু চির কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়নের ক্ষমতা নেই।
সু চির সমর্থকেরা এত দিন বলে আসছিলেন, এই ক্ষমতাহীনতার কারণেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর হওয়া নির্যাতন–নিপীড়নের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না শান্তিতে নোবেলজয়ী এই রাজনীতিক। তবে দ্য হেগে যে ভাষায় সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সু চি, তারপর আর এই যুক্তিকে ঢাল বানানো যাচ্ছে না। নিন্দুকেরা বলছেন, দ্য হেগে দেওয়া নিজের বক্তব্যে সামরিক বাহিনীর অবস্থান থেকে নিজেকে পৃথক করার সুযোগ ছিল সু চির। এমনকি তা সম্ভব না হলে, বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত থাকার সুযোগও ছিল। কিন্তু এর কোনোটাই না করে নিজের নৈতিক অবস্থান হারিয়েছেন সু চি।
গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, গণহত্যা সংঘটনের অসংখ্য প্রামাণিক তথ্য উপস্থাপিত হওয়ার পরও সব নাকচ করে দিয়েছেন সু চি। পুরো বক্তব্যে একবারও রোহিঙ্গা শব্দটিও উচ্চারণ করেননি তিনি। তাঁর এই ব্যক্তিগত অভিব্যক্তিতে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নিতান্ত অনিচ্ছায় মিয়ানমারের বেসামরিক পুতুল সরকারের নেতা হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন না। রাজনৈতিক স্বার্থ সু চিরও আছে। আইসিজেতে বক্তব্য দেওয়ার পর মিয়ানমারজুড়ে সু চির সমর্থনে মিছিল হয়েছে। সু চির এখন লক্ষ্য ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের দলের প্রভাব–প্রতিপত্তি বাড়াতে চান তিনি। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে ক্ষুব্ধ করতে তিনি চান না। জনগণের চোখে ভালো সাজতে গিয়ে বিবেকের ভালো-মন্দ জলাঞ্জলি দিয়েছেন সু চি।
ফরেন পলিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, দ্য হেগের আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে খুব স্পষ্টভাবেই একটি নির্দিষ্ট পক্ষ নিয়েছেন অং সান সু চি। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হওয়া নির্যাতন–নিপীড়নের অভিযোগগুলো মিয়ানমারের স্থানীয় আদালতে, বিশেষ করে সামরিক আদালতে বিচার করার আরজি জানিয়েছেন তিনি। আদালতে অভিযোগকারী গাম্বিয়ার বিভিন্ন তথ্যকে বিভ্রান্তিকর বলে মন্তব্য করেছেন। তাঁর ভাষায়, রোহিঙ্গা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সংঘাতের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে কিছু ঘটনা ঘটেছে, তবে তা গণহত্যার সমতুল্য নয়। সেনাবাহিনীর বলপ্রয়োগের প্রয়োজনীয়তার পক্ষেও তিনি সাফাই গেয়েছেন। অর্থাৎ বেসামরিক সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর অবস্থান কোনোভাবেই সামরিক বাহিনীর বক্তব্যের তুলনায় ভিন্ন নয়।
দ্য ডিপ্লোম্যাট পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আইসিজেতে সু চি সুচিন্তিত ও পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার–নির্যাতনের সব অভিযোগকে ‘অবহেলা’ ও ‘উপেক্ষা’ করেছেন। ওদিকে জাতিসংঘের সাবেক মানবাধিকার–বিষয়ক হাইকমিশনার জাইদ রা’দ আল হুসেইন সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, সু চি যেভাবে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন, তা এককথায় ‘হাস্যকর’।
১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অং সান সু চি। গণতন্ত্র রক্ষায় তাঁর আত্মত্যাগ পেয়েছিল কিংবদন্তির সম্মান। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিজ হাতেই সেই নৈতিক ভাবমূর্তি গুঁড়িয়ে দিয়েছেন সু চি। মন্ত্রিসভায় থাকা সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের গত বছর ‘সুইট’ বলে সম্বোধন করেছিলেন তিনি। এবার তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে মানবতাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলেন অং সান সু চি।