সুয়েজ খালের ১৫০ বছর

১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে সুয়েজ খাল নির্মাণ করা হয়। ছবি: এএফপি
১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে সুয়েজ খাল নির্মাণ করা হয়। ছবি: এএফপি

নানা সংঘাতের সাক্ষী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ সুয়েজ খাল দেড় শ বছরে পা দিতে যাচ্ছে। লোহিত সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ স্থাপনের উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য নিয়ে ১৮৫৯ থেকে ১৮৬৯ সালের মধ্যে এক দশকে খালটি খনন করা হয়।

আজ সোমবার বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, সুয়েজ খাল খনন প্রকল্পের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে কৃতিত্ব দেওয়া হয় ফরাসি কূটনৈতিক ফার্দিনান্দ দে লেসেপসকে। ১৮৬৪ সালে দেওয়া এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, সুয়েজ খালটির ওপর কোনো জাতির বিশেষ অধিকার থাকবে না।

প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য অনুসারে, এক দশক ধরে খালটি খননের কাজে নিয়োজিত ছিল ১০ লাখ মিসরীয়। নির্মাণসামগ্রী পরিবহন করা হতো উট ও খচ্চরের পিঠে চাপিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সুয়েজ খাল নির্মাণ প্রক্রিয়ায় হাজারো মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর ১৬৪ কিলোমিটার দীর্ঘ খালটিতে প্রথম জাহাজ ভাসে। খালটির বিষয়ে ওই সময় বলা হয়, সাগরে বাতাস অনুকূলে থাকলে বিপজ্জনক কঠিন পথ এড়িয়ে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল হয়ে দ্রুত এশিয়ায় যাতায়াত করা যাবে।
তবে এই জলপথকে মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত ও অস্থিরতার ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে সেই চরম মুহূর্তটি উপস্থিত হয়। মিসরের তৎকালীন আইকনিক প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসের আরব বিশ্বের একতার রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি ব্রিটিশ ও ফরাসি স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে খালটি পরিচালনাকারী সংস্থা সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিকে জাতীয়করণ করেন। ওই সিদ্ধান্তের ফলে নিজ দেশে প্রেসিডেন্ট নাসেরের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। তবে তা আন্তর্জাতিক সংকটের সৃষ্টি করে। এর তিন মাস পর সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানিকে নিয়ন্ত্রণকারী দুই দেশ ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পাশাপাশি ইসরায়েল মিসরে হামলা চালায়।

সুয়েজ খালটি ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত চলা আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ক্ষেত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

সুয়েজ খাল নির্মাণের সময় উট ও খচ্চরের পিঠে করে নির্মাণ সামগ্রী পরিবহন করা হয়। ছবি: এএফপি

বর্তমানে সুয়েজ খালটি পরিচালনা করছে সুয়েজ ক্যানেল অথোরিটি। আধুনিক ও বড় জাহাজ চলাচলের সুবিধার্থে ২০১৫ সালে খালটিকে আরও বিস্তৃত করা হয়। সমুদ্র সংক্রান্ত মোট আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ১০ শতাংশ প্যাসেজ সরবরাহের মাধ্যমে এটি এখন প্রধান অর্থনৈতিক সম্পদে পরিণত হয়েছে।
তবে আরব বিশ্বের অস্থিরতা এখনো পিছু ছাড়েনি। মিসরের দক্ষিণাঞ্চলে সিনাই উপদ্বীপ বরাবর মিসরীয় সেনারা খালটি ঘিরে কড়া নজরদারি রেখেছেন। সিনাইয়ের উত্তরাঞ্চলে মিসরীয় সেনারা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

খাল পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষের প্রধান ওসামা রাবি বলেছেন, উনিশ শতকে সুয়েজ খাল প্রাথমিক কাজ সম্পাদনে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এখন এটা হয়ে গেছে ‘মিসরের জীবন রেখা’।
২০১৫ সালে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুয়েজ খালের সমান্তরাল ৭২ কিলোমিটার দীর্ঘ লেন উদ্বোধন করেন। কর্তৃপক্ষের দাবি, এই লেনের কারণে পণ্য পরিবাহী বিশালাকৃতির জাহাজ খাল অতিক্রম করতে পারবে এবং সময়ও আগের চেয়ে কম লাগবে। গত আগস্টে সুয়েজ খালে রেকর্ডসংখ্যক ৮১টি জাহাজ ৬১ লাখ টন পণ্য পরিবহন করেছে এক দিনে।

এখন আরও বিস্তৃত হয়েছ সুয়েজ খাল। ছবি: এএফপি

কর্তৃপক্ষ আরও জানিয়েছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সুয়েজ খাল থেকে ৫৯০ কোটি মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালের মধ্যে এ আয় ১ হাজার ৩২০ কোটি ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে দেশটির।

নানা বৈপরীত্যের ইতিহাসের মধ্যে সুয়েজ খালের ১৫০ বছর উদ্‌যাপনের বড় রকমের আয়োজনের কোনো পরিকল্পনা নেই মিসরের।

ফার্দিনান্দ দে লেসেপস্ এবং সুয়েজ খাল স্মৃতি স্মারক সংস্থার আরনোদ রামিয়ের ফরতানিয়ের বলেন, ১৯৫৬ সালে যা করা হয়েছিল, তা ভুল ছিল। সুয়েজ খাল নিয়ে সৃষ্ট সংকট কোনো পক্ষই ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারেনি। যার ফলে এটাকে ঘিরে ‘দুর্যোগ’ নেমে এসেছিল।
ফরাসি রাষ্ট্রদূত স্টেফানে রোমাতেত বলেন, ১৯৫৬ সালে মিসরীয়রা খালটি জাতীয়করণের মাধ্যমে নিজেরা সুবিধা ভোগ করা শুরু করে। তিনি বলেন, খালটিকে নিয়ে ‘সবাই যার যার মতো ইতিহাস লিখেছে’।

মিসর ও ফ্রান্সে ফার্দিনান্দ দে লেসেপসের ছবিসংবলিত ডাকটিকিট প্রকাশের মাধ্যমে সুয়েজ খালের বর্ষপূর্তি উদ্‌যাপন করা হচ্ছে। ১৩ নভেম্বর মিশরে ‘সুয়েজ খাল: স্মৃতিময় স্থান’ শিরোনামের একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। সুয়েজ ক্যানেল কোম্পানির ঐতিহাসিক প্রাঙ্গণ ইসমাইলিয়া শহরে একটি জাদুঘর নির্মাণ করা হচ্ছে।