উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের উত্তপ্ত বাগ্যুদ্ধ চলছিল অনেক দিন ধরেই। দেশ দুটি পরস্পরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে গেছে অনবরত। এমন একটা ভাব—এক চুলও ছাড় দেবে না কেউ কাউকে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, পরমাণু অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ না করলে বিধ্বংসী হামলা চালিয়ে উত্তর কোরিয়াকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবেন। তিনি মনে করছেন, হুমকি-ধমকি, নিষেধাজ্ঞা ও বাহাদুরি দেখিয়ে উত্তর কোরিয়াকে পরমাণু অস্ত্র কর্মসূচি থেকে সরিয়ে রাখা যাবে। আদতে তিনি উত্তর কোরিয়াকে যত বেশি কোণঠাসা করছেন, তত বেশি যুদ্ধের উসকানি দিয়েছেন। পাল্টা উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনও হুংকার দিয়েছেন। বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের হামলার সক্ষমতা তাঁর আছে। তবে এর জের ধরে আন্তর্জাতিকভাবে কোণঠাসা উত্তর কোরিয়ার ওপর অবরোধ বেড়েছে। এমনকি দেশটির দীর্ঘদিনের মিত্র চীনও নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞায় সমর্থন দেয়।
তবে পর্যবেক্ষকেরা বিশ্বাস করেন, যুক্তরাষ্ট্র আর উত্তর কোরিয়া যতই বাগাড়ম্বর করুক না কেন, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা কম। এর দৃষ্টান্ত হলো সম্প্রতি যখন ট্রাম্প তাঁদের দুই দেশের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকের তারিখ বাতিল করে দেন, তখন কিম দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুনের সঙ্গে দেখা করে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণে সম্মতির কথা জানান। এরপর আবার দুই দেশের মধ্যে বরফ গলে। দুই পক্ষই পূর্বনির্ধারিত ১২ জুন সিঙ্গাপুরে বৈঠক বসতে রাজি হয়। এর পরপরই সিঙ্গাপুরকে ঘিরে শুরু হয় তোড়জোড়। রাত পোহালেই সিঙ্গাপুরের সান্তোসা দ্বীপের কেপেল্লা হোটেলে দুই নেতা বসবেন আলোচনার টেবিলে। এরই মধ্যে দুজনই সিঙ্গাপুরে পৌঁছেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো সিঙ্গাপুরকে কেন বেছে নিল দুই দেশ।
হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুইজারল্যান্ড, মঙ্গোলিয়া ও দুই কোরিয়ার মধ্যবর্তী গ্রাম পানমুনজম ছিল এই বৈঠকের সম্ভাব্য স্থান। কিন্তু তারপরও সিঙ্গাপুরই পছন্দ।
কিন্তু কেন? আসলে খুব কম দেশই আছে, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়া—দুই দেশেরই কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। তা ছাড়া এ শহরটির বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতার বৈঠকসহ বড় বড় অনেক সম্মেলন আয়োজনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যেমন ২০১৫ সালে চীন ও তাইওয়ান বৈঠকস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছিল এই সিঙ্গাপুরকে। ৫৬ লাখ মানুষের দেশ সিঙ্গাপুরে রয়েছে অনেক সুযোগ-সুবিধা। যেমন এখানে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর মানুষ কোনো জবাবদিহি ছাড়াই ব্যাংকে টাকা রাখতে পারে। এমনকি যত দিন না সিঙ্গাপুরের মূল্যবোধে আঘাত লাগে, তেমন কিছু হয়, তত দিন নির্বিঘ্নে এখানে ব্যবসা করা যায়। দেশটিতে রয়েছে কড়া শাসন। সেখানে পুলিশের অনুমতি ছাড়া কোনো বিক্ষোভ বা জনসমাবেশ করা যায় না। কেবল সিঙ্গাপুরের শহরতলিতে স্পিকারস কর্নার নামে একটি জায়গা অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ করতে পারে। তবে অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা বহাল থাকবে। যেমন বিক্ষোভে কোনো বিদেশি অংশ নিতে পারবেন না।
বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের কারণেই কি সিঙ্গাপুরকে বেছে নেওয়া হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তা সিএনবিসি নিউজকে বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।’ তিনি বলেন, সিঙ্গাপুরকে বাছাই করা হয়েছে কারণ, তাঁরা এটি আয়োজন করতে চেয়েছে। কারণ তাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও উত্তর কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। সিঙ্গাপুরের সদিচ্ছা ও সৌজন্যের কারণেই পছন্দ করা হয়েছে। আর উত্তর কোরিয়াও এখানে বৈঠক করতে রাজি হয়েছে।
তবে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিভান বালাকৃষাণ সম্প্রতি ওয়াশিংটনে সরকারি সফরে গিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা বলিনি যে আমরা আয়োজন করতে চাই। প্রথম যুক্তরাষ্ট্রই এই প্রস্তাব দেয়। এরপর উত্তর কোরিয়া। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, সিঙ্গাপুরের লোকজন গর্বিত হবে। গর্ব এ কারণে যে অন্যরা জানে আমরা নিরপেক্ষ, বিশ্বস্ত, নির্ভরযোগ্য, সুরক্ষিত ও নিরাপদ।’
অন্যদিকে উত্তর কোরিয়ার পছন্দের কারণ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাংবাদিকেরা মনে করছেন, উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে খুব বেশি দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। আর যাদের সঙ্গে রয়েছে, তাদের মধ্য সিঙ্গাপুর প্রথম দিকে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে তাদের দূতাবাসও আছে। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে ভিসা ছাড়াই ভ্রমণের সুবিধাও ছিল। তবে সম্প্রতি তা বন্ধ হয়ে গেছে।
গত বছরের শেষ পর্যন্ত উত্তর কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে বাণিজ্য হয়েছে। এমনকি ২০১৬ সালের ওয়াশিংটন পোস্টের খবরে বলা হয়েছিল, কোনো ধরনের তল্লাশি ছাড়াই পিয়ংইয়ং ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে জাহাজ চলাচল করে।
বিবিসির এশিয়া বিজনেস করেসপনডেন্ট কারিশমা বসওয়ানি বলেন, এ বছরের শুরুর দিকে এক তদন্তে দেখা গেছে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সিঙ্গাপুরের দুটি কোম্পানি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। একই কথা বলেছেন জনস হপকিনস ইউনিভার্সিটির ইউএস-কোরিয়া ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং স্কলার মাইকেল মেডেনও। তিনি বলেন, উত্তর কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের নিবিড় অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বন্ধন রয়েছে। তবে সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, উত্তর উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের করতে কোনো ধরনের সহায়তা না দিতে দেশটির আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
কিন্তু গোয়েন্দাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসির খবরে বলা হয়, এসবের চেয়ে কিমের স্বস্তি বোধের বড় কারণ হলো তারা সিঙ্গাপুরকে নিজেদের জন্য নিরাপদ মনে করে। উত্তর কোরিয়ার অনেকের এখানে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে। এমনকি তারা চিকিৎসা করাতেও এখানে আসে।
দ্য ডিপ্লোম্যাট ম্যাগাজিনের নিউইয়র্কভিত্তিক লেখক অঙ্কিত পান্ডা মনে করেন, সিঙ্গাপুর কিমের পছন্দের কারণ হলো দেশটি আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত প্রতিষ্ঠার চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। তাই নিজের দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো নিয়ে কিমকে বিপজ্জনক কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়তে হবে না।
কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের সাউথইস্ট এশিয়াবিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো জোসুয়া কুরলান্তজিক বলেন, নিরাপত্তাই হচ্ছে সিঙ্গাপুরকে বেছে নেওয়ার যৌক্তিক কারণ। ছোট্ট এই রাষ্ট্রটির কূটনৈতিক প্রতিনিধিরা, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সুনাম বিশ্বজুড়ে। তারা বরাবরই দেখিয়ে এসেছে, কোনো ধরনের ত্রুটি ছাড়াই বড় বড় সম্মেলন চমৎকারভাবে আয়োজন করতে পারে সিঙ্গাপুর।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে খেলাটা সিঙ্গাপুরের জন্য খুব সহজ নয়। এই খেলা মানে হলো একদিকে অস্থির ট্রাম্পকে সামলানো, অন্যদিকে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের চাপ সামলানো। তবে সিঙ্গাপুর উভয়ের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মানিয়ে নিয়েছে। দিন দিন দেখা যাচ্ছে এ অঞ্চলের আন্তর্জাতিক ব্যবসার চুক্তিগুলো সিঙ্গাপুরেই হচ্ছে। তাই শুধু এ বৈঠক কেবল রাজনৈতিক বৈঠক নয়। আলোচনার টেবিলে ব্যবসায়িক প্রসঙ্গও আসতে পারে। আর এ বৈঠকে সিঙ্গাপুর মধ্যস্থতাকারী ও আকর্ষণীয় আয়োজক।