সিঙ্গাপুরে অভিবাসী নির্মাণশ্রমিকদের দুঃখগাথা

নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান চুক্তি বাতিল করায় ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন মোস্তফা নামের এক বাংলাদেশি। চাঙ্গি বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর, ২৮ মার্চ, ২০১৭। ছবি: রয়টার্স
নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান চুক্তি বাতিল করায় ঋণের বোঝা কাঁধে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফেরেন মোস্তফা নামের এক বাংলাদেশি। চাঙ্গি বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর, ২৮ মার্চ, ২০১৭। ছবি: রয়টার্স

নানা কর্মকাণ্ডে ব্যতিব্যস্ত এক ড্রপ ইন সেন্টার। সেখানে খাতায় সই করতে পুরুষদের লম্বা সারি। নাম সই করে প্রত্যেকে টোকেন নিচ্ছে। এ দিয়ে মিলবে বিনা মূল্যে খাবার। সিঙ্গাপুরের লিটল ইন্ডিয়া ডিস্ট্রিক্টে সস্তার কয়েকটি হোটেলে এ টোকেন দিয়ে খাবার পাওয়া যাবে।

সারিতে দাঁড়ানো এই পুরুষেরা সবাই অভিবাসী নির্মাণশ্রমিক। তাঁরা এখন চাকরিহারা। অনেকে আবার বকেয়া বেতনের জন্য ঘুরছেন। এই সেন্টার চালায় অভিবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা ট্রানজিয়েন্ট ওয়ার্কার্স কাউন্ট টু (টিডব্লিওসি২) নামের একটি সংস্থা। সেখানে প্রতি রাতে ৫০০ জনের বেশি মানুষ আসে।

সিঙ্গাপুরের অবকাঠামো খাতই দেশটির অর্থনীতিকে চাঙা করে রেখেছে। আর এর জন্য দেশটিকে প্রচুর বিদেশি শ্রমিকের ওপর নির্ভর করতে হয়। জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের ২০১৭ সালের জুনের এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার ও চীন থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০ শ্রমিক এখানকার নির্মাণশিল্পে নিয়োজিত।

বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে শ্রমিক হিসেবে গিয়েছেন সরদার মো. ইনসান আলী। স্বপ্ন ছিল সিঙ্গাপুরের অবকাঠামো খাত তাঁর জীবনকে পাল্টে দেবে। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে সুখের জীবন হবে তাঁর। গত বছর এই শহরে আসেন তিনি। বলা হয়েছিল, মাসে তাঁকে ১ হাজার ৬০০ সিঙ্গাপুরি ডলার দেওয়া হবে। বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ ১ হাজার ৬৩৮ টাকা।

অথচ পৌঁছানোর পর তিনি দেখলেন, প্রতিদিন তাঁর মজুরি মাত্র ১৮ সিঙ্গাপুরি ডলার। নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান প্রথম আট মাস তাঁকে পুরো বেতন দিতে রাজি নয়। ইনসান আলী বলেন, মালিক মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ সিঙ্গাপুরি ডলার দিয়েছিল। এর মধ্য থেকে খুব অল্প নিজের জন্য রেখে বাকিটা দেশে পরিবারের কাছে পাঠাতেন।

তামেরা ফিলিংগারের কাছে এ এক পরিচিত গল্প। তিনি প্রতি বুধবারের টিডব্লিওসি২ ক্লিনিক সামলাতে সহায়তা করেন। কাজ করতে গিয়ে যেসব বিদেশি শ্রমিক আহত হন, ক্লিনিকটি তাঁদের সহায়তা দেয় এবং প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব শ্রমিকের বেতন দাবি করে।

তামেরা বলেন, এসব শ্রমিকের দিনের পর দিন কেটে যায় কেবল মালিকপক্ষের আশ্বাসে। তাঁদের বলা হয়, কয়েক মাসের মধ্যে তাঁদের পুরো বেতন দিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু অনেকেই মাসের পর মাস কোনো মজুরি পান না। বেশির ভাগ সময়ই এসব শ্রমিক প্রতারণার শিকার হন, কম মজুরি পান। যখন সব মালিকপক্ষ একসঙ্গে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার বিষয়ে নিজেদের হাত গুটিয়ে নেয় অথবা প্রত্যাখ্যান করে, যখন শ্রমিকেরা বুঝতে পারে মালিকপক্ষের আশ্বাস শুধু আশ্বাসই, তখনই নিজেদের দাবিতে জেগে ওঠেন শ্রমিকেরা।

কাজ করার পরও অনেক অভিবাসী শ্রমিকের কপালে জোটে না ন্যূনতম মজুরি। প্রযুক্তির জন্য প্রসিদ্ধ সিঙ্গাপুর সিটিতে নিজের পাওনার জন্য সংগ্রাম করতে হয় তাঁদের।

সিঙ্গাপুরের জনশক্তি মন্ত্রণালয় জানায়, ২০১৬ সালে তারা প্রায় সাড়ে চার হাজার নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে বেতনসংক্রান্ত নয় হাজার অভিযোগ পেয়েছে। কর্মীদের মধ্যে স্থানীয় ও বিদেশি সবাই রয়েছেন।

সংসদীয় এক প্রশ্নের মুখে সিঙ্গাপুরের জনশক্তিমন্ত্রী লিম সুয়ে সে জানান, মধ্যস্থতা বা শ্রম আদালতের মাধ্যমে এসব মামলার ৯৫ শতাংশ সমাধান হয়। বেতন পরিশোধ না করায় গত তিন বছরে ১৫৮ জন নিয়োগকারী দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।

হিউম্যানিটারিয়ান অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন ইকোনমিকসের (হোম) নির্বাহী সমাজকর্মী জেভন এনজি বলেন, শাস্তির সংখ্যাটা কম। কারণ, সরকার তার ব্যবসাবান্ধব খ্যাতি বজায় রাখতে শাস্তির পরিবর্তে আপসকে প্রাধান্য দেয়। তিনি বলেন, নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে নিয়ম ভাঙার এবং শ্রমিকদের সঙ্গে বেতন নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারের একধরনের অনাগ্রহ কাজ করে।

চাকরি হারিয়ে বাড়ি ফেরা হুসেইন (বাঁ দিকে)। চাঙ্গি বিমানবন্দর, সিঙ্গাপুর, ২৮ মার্চ, ২০১৭। ছবি: রয়টার্স

অথচ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানায়, যেসব নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইচ্ছে করে শ্রমিকদের পাওনা দিতে চায় না, তাদের বিরুদ্ধে তারা মামলা চালায়। ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে তারা পুরো বেতন আদায় করতে সফল হয়।

মন্ত্রণালয় জানায়, সব নিয়োগকারীকে তারা অপরাধী হিসেবে দেখতে চায় না, বিশেষ করে যাঁরা ব্যবসা করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। যেসব শ্রমিক তাঁদের পাওনা পাবেন না, তাঁদের বিকল্প সহায়তা দেওয়া হয়।

হতাশ হয়ে বাংলাদেশের সরদার মো. ইনসান আলী ও তাঁর দুই সহকর্মী মন্ত্রণালয়ে গত সেপ্টেম্বরে অভিযোগ জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বেশির ভাগ শ্রমিকের জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন। কেননা, নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানালে এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। সিঙ্গাপুরের আইন অনুযায়ী, শ্রমিকদের কাজের অনুমতির (ওয়ার্ক পারমিট) বিষয়টি নিয়োগকর্তাদের ওপর নির্ভরশীল। মালিক চাইলে তিনি তা বাতিল করতে পারেন।

এ বছরের শুরুর দিকে হোম প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিবাসী শ্রমিকদের সিঙ্গাপুরে কাজ পেতে এজেন্টদের বা রিক্রুটমেন্ট ফি বাবদ ৩ হাজার থেকে ১৫ হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার দিতে হয়। আর এ ফি দিতে গিয়ে অনেক শ্রমিককে তাঁদের ভিটেবাড়ি, গয়না বিক্রি করে বা আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার বা ব্যাংকঋণ করতে হয়। এসব কারণে শ্রমিকদের ওপর অর্থ উপার্জনের একধরনের চাপ থাকে। তাই অনেক বিদেশি শ্রমিক মনে করেন, কোনো অর্থ না পাওয়ার চেয়ে কিছুটা পাওয়া ঢের ভালো।

সরদার মো. ইনসান আলী মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ করার পর তাঁর ওয়ার্ক পারমিট বাতিল হয়ে যায়। এবং গত বছরের ২১ অক্টোবর তাঁকে দেশে ফিরে যেতে বলা হয়। যা-ই হোক, এরই মধ্যে দেশটির সরকার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। বলেছে, যত দিন তাঁর মামলা চলবে, তিনি এখানে থাকতে পারবেন। তবে কোনো কাজ করতে পারবেন না।

তামেরা বলেন, আইনি এই কড়াকড়িতে শ্রমিকদের জন্য কাজ করা কঠিন। যদি মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে এক বেকার শ্রমিককে থাকা-খাওয়ার খরচ বহন করতে হয়, তাহলে তিনি কীভাবে এ দেশে থাকবেন? এ ক্ষেত্রে নিয়োগকারীর এ খরচ বহনের কথা থাকলেও অনেকেই তা দেয় না।

সিঙ্গাপুরের আইন অনুযায়ী, বৈধ বেতনধারী সব শ্রমিকেরই তাঁদের নিয়োগদাতা পরিবর্তনের অধিকার রয়েছে। তবে এসব অভিবাসী শ্রমিকের সহায়তাকারী বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কর্মীরা জানান, এটা সব সময় সম্ভব হয় না। মন্ত্রণালয়ের এক হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের প্রথম ছয় মাসে ৬০০ অভিবাসী শ্রমিক তাঁদের নিয়োগদাতা পরিবর্তনের আবেদন করেছেন। তবে মাত্র অর্ধেক লোকজনই নতুন কাজ পেয়েছেন।

সমাজকর্মী জেভন এনজি বলেন, শ্রমিকেরা যদি নিয়োগদাতা পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও যান, কিন্তু মাসের পর মাস বেতন না পেয়ে তত দিনে তাঁরা নিঃস্ব।

সিএনএন অবলম্বনে লিপি রানী সাহা