কোভিড-১৯ মহামারির এই সময়ে বিশ্বের শতকোটিপতিদের অনেকেই আর্থিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। চীনের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি জ্যাক মাও তার ব্যতিক্রম নয়। কোভিড-১৯ যখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ল, ঠিক সেই সময় অর্থাৎ গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে এসে তিনি প্রথমবারের মতো টুইটার অ্যাকাউন্ট খোলেন। সেখানে তিনি বিশ্বের সবাইকে একযোগে এই লড়াইয়ে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান।
এ ক্ষেত্রে জ্যাক মার প্রথম বার্তাটি ছিল, 'এক বিশ্ব, এক লড়াই'। পরবর্তী দিনগুলোয় তাঁর কার্যক্রমও ছিল নিজের দেওয়া বার্তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বিশ্বের দেড় শতাধিক দেশে চীন যে চিকিৎসা সরঞ্জামের সরবরাহ দিয়ে চলেছে, তার পেছনের প্রধান ব্যক্তিটি জ্যাক মা। তারপরও তাঁর অনুসারী থেকে শুরু করে সমালোচকেরা তাঁর কার্যক্রমের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয়াচ্ছন্ন। মূলত একজন মুনাফামুখী শতকোটিপতি বা বিলিয়নিয়ার, যিনি এই কিছুদিন আগেও দিনে ১২ ঘণ্টা কাজের প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন, তাঁর এমন জনসেবায় আত্মনিয়োগের পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজতে অনেকেই তৎপর।
বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জ্যাক মা যেভাবে বিশ্বব্যাপী দাতব্য কাজে নেমেছেন, তাতে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধু হিসেবে তিনি এসব করছেন, নাকি দলটি তাঁর এই ব্যক্তি উদ্যোগকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে? মজার বিষয় হলো এই পুরো কার্যক্রমে জ্যাক মা চীনের কূটনৈতিক রীতি অনুসরণ করছেন। কোন দেশ এই সহায়তা আগে পাবে বা কী পরিমাণ পাবে, সে বিষয়টি নির্ধারণে অনেকাংশেই চীনা কূটনৈতিক ধারাই অনুসৃত হচ্ছে। আর এতে করে জ্যাক মা হয়তো চীনের রাজনৈতিক স্তম্ভের ওপরের দিকে থাকা নেতাদের কিছু অংশকে শঙ্কিত করে তুলছেন।
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রযুক্তি মোগলদের অনেকেই অবশ্য আর্থিক সহায়তা করছেন। এ খাত থেকে আসা আর্থিক অনুদানের তালিকা ধরলে অবশ্য জ্যাক মার অবস্থান অনেক পেছনে থাকবে। বেসরকারি খাত থেকে আসা অনুদানের যে তালিকা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ক্যানডিড করেছে, তাতে জ্যাক মার প্রতিষ্ঠান আলিবাবার অবস্থান ১২তম। কিন্তু এই তালিকা জ্যাক মার কার্যক্রম সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা দেবে না। কারণ, এতে অন্য দেশে চীনা চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাতে যে পরিবহন ব্যয় জ্যাক মা বহন করছেন, তা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। অথচ এই জরুরি সরঞ্জামই এখন অনেক দেশের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ তালিকায় জ্যাক মা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন শুধু ভ্যাকসিন নিয়ে চলমান গবেষণায় তাঁর দেওয়া আর্থিক সহায়তার বলে।
জরুরি সরঞ্জাম দেশে দেশে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে জ্যাক মা অবশ্য অন্যদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছেন। আলিবাবার কল্যাণেই আফ্রিকা, এশিয়া, ইউরোপ, দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন দেশে যেমন, তেমনি ইরান, ইসরায়েল, রাশিয়ার মতো রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান—এমন অঞ্চলগুলোতেও সরবরাহ চেইন তাঁর হাতের মুঠোয়। ফলে এ ক্ষেত্রে অবদান রাখাটা তাঁর পক্ষে তুলনামূলক সহজ। সঙ্গে তাঁর আর্থিক সামর্থ্য ও সেই সূত্রে পাওয়া ক্ষমতা তো রয়েছেই।
এ বিষয়ে জ্যাক মার জীবনীকার ডানকান ক্লার্ক বলেন, 'তাঁর অর্থ ও প্রতিপত্তি রয়েছে। প্রয়োজন পড়লে চীন থেকে জরুরি সরঞ্জামবাহী উড়োজাহাজকে তিনি আদ্দিস আবাবায় নিয়ে যেতে পারেন।'
একজন ইংরেজি শিক্ষক থেকে চীনের সবচেয়ে বড় প্রযুক্তি কোম্পানির উদ্যোক্তা বনে যাওয়া জ্যাক মা বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছেন। আর এই পর্যায়ে আসতে তাঁর লেগেছে মাত্র ২১ বছর। ২০১৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আলিবাবার চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও আলিবাবার পরিচালনা পর্ষদের একটি স্থায়ী পদে তিনি রয়ে গেছেন। ওই সময়েই শুধু সেবাকর্মে আত্মনিয়োগ করবেন বলে জানালেও চীনের অন্যতম ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অবস্থানের কোনো নড়চড় হয়নি। চীনা সরকারের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক বেশ ভালো।
কতটা ভালো, তা বোঝা যায় এই দুর্যোগকালেও তাঁর দেওয়া অনুদানের গন্তব্য দেখে। চীন সরকারের অনুসৃত কূটনৈতিক পথ অনুসরণ করেই জ্যাক মা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছেন। জ্যাক মা বা আলিবাবা ফাউন্ডেশনের কোনো আর্থিক সহায়তা সেই সব দেশ পায়নি, যাদের সঙ্গে তাইওয়ানের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে। টুইটারে জ্যাক মা দক্ষিণ আমেরিকার ২২ দেশে সহায়তা পাঠানোর ঘোষণা দেন, যাদের কেউ তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক রাখে না। একই সময়ে হন্ডুরাস ও হাইতি থেকেও সহায়তার আহ্বান জানানো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মা-এর বদান্যতা পাওয়া দেড় শ দেশের দীর্ঘ তালিকাতেও তাদের জায়গা হয়নি।
সমালোচকদের দিক থেকে আসা এসব সমালোচনাকে পাশ কাটিয়ে জ্যাক মার সাফল্য কম নয়। এই সময়ে বিশ্বের দেড় শ দেশে জরুরি সরঞ্জামের সরবরাহ পৌঁছে দেওয়াও তো কম নয়। এই মুহূর্তে এত বিরাট কাজ আর কতজন করছেন? বিশেষত আফ্রিকার কথা যদি বিবেচনায় আনা হয়, তবে জ্যাক মার অবদানকে কোনোভাবে ছোট ভাবার কারণ নেই। আফ্রিকার অনেক দেশ শুধু তাঁর কাছ থেকেই জরুরি সরঞ্জামের সরবরাহ পেয়েছে। রাষ্ট্র হিসেবে চীনের পাঠানো সরঞ্জামের মান নিয়ে নানা সমালোচনা হলেও, তার বা আলিবাবা ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে এমন সমালোচনা হয়নি। অন্য শতকোটিপতিরা যেখানে ওষুধ ও ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণাতেই বেশি মনোযোগী, সেখানে জ্যাক মা এগুলোর পাশাপাশি এই সময়ে প্রাণ বাঁচাতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের দিকে সমান মনোযোগী।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে ওষুধ ও ভ্যাকসিন তৈরির গবেষণায় সবার অর্থায়নের একটি সম্ভাব্য লাভজনক ভবিষ্যৎ রয়েছে। সে হিসেবে জ্যাক মার এই আর্থিক সহায়তার তেমন সুস্পষ্ট লাভজনক ভবিষ্যৎ নেই। তবে অন্য সম্ভাবনা রয়েছে। চীনা পত্রিকাগুলোয় প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখন জ্যাক মার খবর ও ছবি সমানতালে বেরোচ্ছে। এটি একই সঙ্গে সম্ভাবনা ও শঙ্কাও। কারণ, এতে 'আংকেল সি' যদি জ্যাক মার ওপর চটে যান, তবে সমূহ বিপদও কিন্তু আছে। এমনিতেই গুঞ্জন রয়েছে যে ২০১৮ সালে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চাপেই তিনি আলিবাবার চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন, যা ওই সময়েই খারিজ করে দেন জ্যাক মা। অবশ্য এই গুঞ্জনের প্রসঙ্গটিকে সামনে নিয়ে আসছেন ওয়াশিংটন ডিসিভিত্তিক সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির গবেষণা সহযোগী অ্যাশলি ফ্যাং।
এই সময়ে জ্যাক মার কার্যক্রমের কোনো কিছুই অবশ্য চীনা সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে না। চীন সরকারের স্বার্থ রক্ষা করেই তিনি এগোচ্ছেন। শুধু চীন অনুসৃত কূটনৈতিক ধারা অক্ষুণ্ন রেখেই নয়, বহির্বিশ্বে চীনের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারেও তাঁর এ কার্যক্রম বড় ভূমিকা রাখছে। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন দেশে চীনের ভূমিকা ক্রমেই আগ্রাসী হয়ে উঠছে, বাণিজ্য ক্ষেত্রে সম্প্রসারণবাদী ভূমিকা বাড়ছে ইত্যাদি যেসব সমালোচনার জন্ম দিয়েছিল রাষ্ট্রটি, তার বদলে এক সহযোগী ও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবেই চীনের ভাবমূর্তি তুলে ধরছেন জ্যাক মা।
জ্যাক মা যে উদ্দেশ্যেই এই সহায়তা করে থাকুন না কেন, তাঁর দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য যা-ই হোক না কেন, সত্য হচ্ছে এই সময়ে তাঁর পৌঁছে দেওয়া সহায়তা অনেক দেশের অনেকে মানুষের মধ্যে আশা জাগাচ্ছে। কোভিড-১৯–এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দানে থাকা মানুষ যখন আপাতত সুরক্ষার বর্মটি পাচ্ছে, তখন সে সাহস পাচ্ছে, যা তাকে বেঁচে থাকার দমটি দিচ্ছে। সারা বিশ্বের মানুষের হয়ে জ্যাক মার এই লড়াইকে তাই এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।