তালেবান আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকেই একের পর এক সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে দেশটিতে। নিরাপত্তার অভাব, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ—এগুলো কাঁধে নিয়ে চলছে আফগানরা। দিন গড়ানোর সঙ্গে তারা এবার নতুন এক সমস্যার মুখে পড়েছে—অর্থের অভাব। আফগানদের হাতে থাকা নগদ অর্থ ফুরিয়ে আসছে।
১৫ আগস্ট তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর প্রায় দুই সপ্তাহ গড়িয়েছে। এখনো চালু হয়নি আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো। ফলে জমানো অর্থেও হাত দিতে পারছে না দেশটির বাসিন্দারা। এর প্রভাব পড়েছে তাদের জীবনযাপনের ওপর। দিনের খরচও মেটাতে পারছে না তারা।
তালেবানের ক্ষমতা দখলের দিন থেকেই বন্ধ রয়েছে আফগানিস্তানের ব্যাংকগুলো। অর্থের অভাবে সেগুলো চালুও করা যাচ্ছে না। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অবস্থাও নড়বড়ে। অনেক কর্মী এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। ব্যাংকটির একটি সূত্র যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএনকে বলেছে, নতুন শাসনব্যবস্থায় তাঁরা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।
এমন পরিস্থিতিতে ২৩ আগস্ট আফগানিস্তানের ব্যাংকিং অবস্থা নিয়ে স্মারকলিপি পাঠিয়েছে আফগান-আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স। সেখানে সংকটের নানা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। স্মারকলিপিতে বলা হয়, আফগান ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে চাইছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকটির কাছে নগদ অর্থের জন্য আবেদন জানিয়েছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। তবে তাদের সেই আবেদন রাখা হয়নি।
এদিকে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর প্রথম দিকে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকটিতে কোনো গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এটিকেও দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে স্মারকলিপিতে। অবশ্য এর পরপরই হাজি মোহাম্মদ ইদ্রিসকে গভর্নর পদে বসানো হয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ এ পদে ইদ্রিসের নিয়োগ হয়েছে শুধু তালেবানের কাছে বিশ্বস্ত থাকার মাপকাঠিতে। আফগানিস্তানের ব্যাংকিং ব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর তেমন ধারণা নেই বললেই চলে।
সমস্যা এখানেই থেমে নেই। আফগানিস্তানের অর্থনীতি মূলত টিকে আছে বিদেশি সহায়তার ওপর। বিশ্বব্যাংক বলছে, সরকারি বিভিন্ন খাতের ৭৫ শতাংশ খরচই মেটে বিদেশি সহায়তা থেকে। তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের পর থেকে এসব সহায়তার বেশির ভাগই বন্ধ রয়েছে।
সিএনএনের খবরে বলা হয়, তালেবানের কারণে মহাসংকটে পড়তে হচ্ছে আফগানিস্তানের বাসিন্দাদের। প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে আর্থিক এ সংকট মোকাবিলার পথ। কাবুলের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে চলে যাওয়ার পরপরই যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আফগানিস্তানের জমা থাকা রিজার্ভের অর্থ জব্দ করে রেখেছে মার্কিন সরকার। ফলে সেই অর্থে হাত দিতে পারছে না তালেবান। তালেবানের দুর্নামের কারণে বেঁকে বসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ)। আফগানিস্তানে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার তহবিল পৌঁছানোর কথা ছিল। তবে তা স্থগিত করে দেওয়া হয়। আর্থিক সহায়তা বন্ধ রেখেছে বিশ্বব্যাংকও।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা অর্থ ছাড় করার আবেদন জানিয়েছে আফগানিস্তানের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। আফগান-আমেরিকান চেম্বার অব কমার্সের পাঠানো স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা অর্থ ছাড় না হলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এমনকি ব্যবসা গোটানোর পদক্ষেপও নিতে হতে পারে। এ ছাড়া মানুষের হাতে অর্থ না থাকায় তারা খাবারসহ মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারবে না। ফলে তাদের মধ্যে হতাশা দেখা দিতে পারে, এমনকি পরিস্থিতি সহিংসতার দিকেও যেতে পারে।
আফগানিস্তানের এমন নড়বড়ে পরিস্থিতির মধ্যে সরকার চালানো তালেবানের জন্য বেশ কঠিন হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে ইসলামিক স্টেটসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে ধারণা তাঁদের। সব মিলিয়ে আফগানরা মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আফগানিস্তানের অর্থনীতি নিয়ে সম্প্রতি সিএনএনের সঙ্গে কথা বলেছেন আজমল আহমাদি। তিনি দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক প্রধান। তালেবান আফগানিস্তান দখলের পর দেশ ছাড়েন তিনি। সিএনএনের সঙ্গে আলাপচারিতায় আজমল আহমাদি অর্থনৈতিক দুর্দশা, তারল্যের সংকট, মুদ্রাস্ফীতি এবং মানুষের দেশছাড়ার বিষয়টি নিয়ে সতর্ক করেন।
এ সময় আফগানিস্তান ছেড়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রকে না যাওয়ার অনুরোধ করেন আজমল আহমাদি। তিনি বলেন, মানবিক সহায়তা শুধু চালু রাখলেই হবে না, আগামী দিনগুলোতে তা বাড়াতেও হবে। আফগানিস্তানের ৪৭ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে বলে উল্লেখ করেছে বিশ্বব্যাংক। এ তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করে আহমাদি বলেন, ‘আমরা আরেকটি বিপর্যয়ের জন্য বসে থাকতে পারি না।’