শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার প্রধান সন্দেহভাজন জাহরান হাশিমের অন্তত ১৮ জন স্বজন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর এক অভিযানে নিহত হয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। শ্রীলঙ্কার পুলিশ জানিয়েছে, গত শুক্রবার এক অভিযানে হাশিমের বাবা ও দুই ভাই নিহত হয়েছেন। তবে হাশিমের বোন বলছেন, তিনি ছবি দেখে বিশ্বাস করেন না যে তাঁরা (স্বজন) নিহত।
শ্রীলঙ্কার গির্জা ও হোটেলে আক্রমণকারীদের মধ্য অন্যতম হলেন জাহরান হাশিম। তিনি দেশটির উগ্রপন্থী ইসলামি গোষ্ঠী ন্যাশনাল তৌহিদ জামায়াতের (এনটিজে) নেতা। তিনি এই হামলার প্রধান সন্দেহভাজন। হাশিম ২০১৪ সালে কাত্তানকুদিতে এনটিজে প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীলঙ্কার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২১ এপ্রিল আত্মঘাতী হামলার দিনে নিহত হন জাহরান হাশিম।
২১ এপ্রিলের হামলার পর শুক্রবার হাশিমের শহরের বাড়ির কাছে একটি বাড়িতে অভিযান চালায় শ্রীলঙ্কার নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য। ওই অভিযানে তিনজন জঙ্গি নিজ নিজ শরীরে বোমা বেঁধে বিস্ফোরণ ঘটায়। এ ছাড়া অভিযানে আরও ছয় শিশু ও তিন নারী নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে হত হয় তিন ব্যক্তি। বলা হচ্ছে, এরাই সবাই হাশিমের পরিবারের সদস্য।
সিএনএনের খবরে বলা হয়, জাহরান হাশিমের ১৮ স্বজনের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ ব্যাপারে জাহরান হাশিমের বোন হাশিম মাথানিয়া আশঙ্কা প্রকাশ করে সিএনএনকে বলেন, নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানে তাঁর ওই স্বজনেরা নিহত হয়ে থাকতে পারেন। থানায় রাখা ছবি দেখে মাথানিয়া এক স্বজনকে শনাক্ত করেছেন। ২১ এপ্রিলের সিরিজ বোমা হামলার পর তাঁর পরিবারের পাঁচজন সদস্য নিখোঁজ। তিন ভাই, বাবা এবং বোনের স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
শুক্রবারের অভিযানে নিহত একজন হলেন মো. নিয়াজ। তিনি এনটিজের একজন সদস্য। নিয়াজ হাশিম মাথানিয়ার বোনের স্বামী।
হাশিম মাথানিয়া সিএনএনকে বলেন, ‘নারী-পুরুষের লাশ না দেখা পর্যন্ত আমি ধাক্কা খাইনি। পুলিশ যখন ছয় শিশুর কথা বলেছে, এরপরই আমার মনে হয়েছে যে তাঁরা আমার কেউ হবেন। অভিযানের দিনে ওই বাড়িতে পাঁচজন নারী ছিলেন। তাঁরা আমার তিন ভাইয়ের স্ত্রী, আমার ছোট বোন এবং আমার মা। তাঁদের সবার সাত শিশুসন্তান আছে।’
হাশিম মাথানিয়া বলেন, জাহরান হাশিমের স্ত্রী ও কন্যাশিশু এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শুক্রবারের হামলার পরে পুলিশ বলেছিল, অভিযানের পর একজন নারী ও এক শিশুকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার গির্জা ও হোটেলে আক্রমণকারীদের মধ্য মোবারক আাজান ও জাহরান হাশিমের নাম প্রকাশ করেন দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। শ্রীলঙ্কার কর্তৃপক্ষ এখনো বাকি আত্মঘাতী হামলাকারীদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে পারেনি।
শ্রীলঙ্কার পুলিশ বলেছে, হামলাকারী সবাই শ্রীলঙ্কান। তারা নয়জন হামলাকারীর মধ্যে একজন নারীকে শনাক্ত করেছে। ওই নারীর নাম ফাতিমা ইব্রাহিম। তিনি শ্রীলঙ্কার কোটিপতি ব্যবসায়ী ইনসাফ আহমদ ইব্রাহিমের স্ত্রী।
ভারতের গোয়েন্দা বাহিনীর বরাত দিয়ে দেশটির সংবাদমাধ্যম ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলাকারী হিসেবে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) তাদের যে আট সদস্যের ছবিসংবলিত ভিডিও প্রকাশ করেছে, তাতে ফাতিমাও আছেন। ওই ছবিতে সাতজনকে এক সারিতে ও পেছনে একজনকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখা যায়। ভারতের গোয়েন্দারা বলছেন, পেছনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ফাতিমা। আর ফাতিমার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বামী ইনসাফ।
ফার্স্টপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় সিরিজ বোমা হামলার দিন রাতে ইব্রাহিমের বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে তল্লাশি চালায় পুলিশ। এ সময় অন্তঃসত্ত্বা ফাতিমা তাঁর তিন সন্তানকে নিয়ে আত্মঘাতী হন। ইনসাফের পরিবার তাঁর আরেক ভাই ইলহাম ইব্রাহিমের সঙ্গে তিনতলাবিশিষ্ট ওই অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। ইব্রাহিম পরিবার শ্রীলঙ্কার শীর্ষ ব্যবসায়ীদের অন্যতম। ইনসাফ ইব্রাহিমের বাবা মোহাম্মদ ইউসুফ ইব্রাহিম কোটিপতি মসলা ব্যবসায়ী। ইনসাফের মূল ব্যবসা তামা দিয়ে তৈরি পণ্য। ভারতের গোয়েন্দারা বলছেন, তাঁর এক কারখানায় হামলার বোমাগুলো প্রস্তুত করা হয়েছে।
দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় ২১ এপ্রিল ধারাবাহিক বোমা বিস্ফোরণে ২৫৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত অন্তত ৫০০ জন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ জন বিদেশি নাগরিক। ওই দিন তিনটি গির্জা ও তিনটি বড় হোটেলে একযোগে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই দিন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডে উপলক্ষে গির্জায় প্রার্থনা চলছিল। ওই সময় এসব বিস্ফোরণ ঘটে। ওই দিনই পরে আরও দুটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
হামলার তিন দিন পরে গত মঙ্গলবার আইএস হামলার দায় স্বীকার করে। তবে দায় স্বীকার করলেও এর পক্ষে কোনো প্রমাণ দেয়নি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনটি।
২১ এপ্রিলের বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে—এমন সন্দেহে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকজন বিদেশি নাগরিকসহ মোট ৭৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে শ্রীলঙ্কার পুলিশ। তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার জন্য ও উপাসনালয়গুলোয় নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য প্রায় ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে।