কথায় আছে, রাজা যায় রাজা আসে। দ্বীপদেশ শ্রীলঙ্কাতেও তেমনটাই হয়েছিল। কিন্তু সেখানে নতুন রাজা বেশি দিন টিকতে পারলেন না। আগের চেয়েও দোর্দণ্ড প্রতাপে ফিরে এসেছেন পুরোনো রাজা। তবে এবার রাজা সঙ্গে করে রাজপরিবারের অন্য সদস্যদেরও নিয়ে এসেছেন। অবস্থা যেমন তাতে বলাই যায়, শ্রীলঙ্কায় এখন সবাই রাজার পক্ষে!
নতুন করোনাভাইরাসের কারণে দুই দফা পেছানোর পর চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই নির্বাচনে বিপুল বিজয় অর্জন করেছে রাজাপক্ষে পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন ‘শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা’ (এসএলপিপি) নামের রাজনৈতিক দলটি। পার্লামেন্টের ২২৫টি আসনের মধ্যে ১৪৫টিই গেছে দলটির দখলে। এ ছাড়া মিত্র দলগুলোর জেতা আরও ৫টি আসন এসএলপিপির হিসাবে যুক্ত হবে। সব মিলিয়ে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেছে মাহিন্দা রাজাপক্ষের দল। অর্থাৎ, এখন সংবিধান পরিবর্তনসহ নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলো রাজাপক্ষে পরিবার। বার্তা সংস্থা এএফপি জানাচ্ছে, ৫ আগস্টের নির্বাচনে প্রায় ৬৮ লাখ ভোট পেয়েছে এসএলপিপি। মোট ভোটারের ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট দিয়েছেন এই নির্বাচনে।
মাহিন্দা রাজাপক্ষে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালে পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ২০০৯ সালে তামিল বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমন করে গৃহযুদ্ধের অবসানে সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন মাহিন্দা। তাঁর নীতির কারণেই ‘শক্ত হাতে’ তামিলদের দমন করা হয়েছিল। তাঁর শাসনামলে সংখ্যালঘু ও বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন-পীড়নের অভিযোগ আছে। আছে দুর্নীতির অভিযোগও। হুট করেই ২০১৫ সালে তাঁর বিরোধীরা এক জোট হয়ে নির্বাচনে নামে। পতন হয় মাহিন্দা রাজাপক্ষের। তখন ক্ষমতায় এসেছিল রনিল বিক্রমাসিংহের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট। কিন্তু গত বছর ইস্টার সানডের দিনে ভয়ংকর বোমা হামলা হওয়ার পর সেই জোটের জনপ্রিয়তাতে ধস নামে।
ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ বলছে, মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারের নিয়ন্ত্রণাধীন রাজনৈতিক দলের এমন বিশাল বিজয় আশ্চর্যজনক ছিল না। বোমা হামলার ঘটনার পর থেকেই জাতীয়তাবাদকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির জোয়ার তুলতে থাকে এসএলপিপি। শুরু হয় সাম্প্রদায়িক বিভাজনের নীতি বাস্তবায়ন। কারণ রাজাপক্ষে পরিবার মূলত শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ সিংহলি সম্প্রদায়ভুক্ত। মাহিন্দার রাজনৈতিক কৌশল বরাবরই সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষাবলম্বন করে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার দায় তাদের নেই। আর এই কৌশলেই কিস্তিমাত করেছে শ্রীলঙ্কা পদুজানা পেরামুনা।
রাজাপক্ষে পরিবারের বিজয়ের ইঙ্গিত বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিল। গত নভেম্বরেই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিপুল ব্যবধানে জিতে যান মাহিন্দার ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষে। তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, এক পরিবারের একচ্ছত্র শাসন আবার ফিরে আসতে পারে। প্রেসিডেন্ট হয়েই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বড় ভাই মাহিন্দাকে নিয়োগ দেন গোতাবায়া। শুরু হয় দুই ভাইয়ের শাসন। এখন তা আরও পোক্ত হলো। এরই মধ্যে জানা গেছে, প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও নতুন সরকারে থাকছেন রাজাপক্ষে পরিবারের আরও তিন সদস্য। অর্থাৎ নতুন সরকারের মূল চাবি থাকছে রাজাপক্ষে পরিবারের হাতে।
নির্বাচনে সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয়েছে রাজাপক্ষের বিরোধীদের। ‘গার্ডিয়ান’-এর নিবন্ধে বলা হয়েছে, রনিল বিক্রমাসিংহের দল মোটে একটি আসন পেয়েছে। অথচ গত নির্বাচনে ১০৬টি আসন পেয়ে সরকার গঠন করেছিল দলটি। তার ওপর নির্বাচনের আগ দিয়ে রনিলের দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি ভেঙে যায়। সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সজিথ দল ভেঙে নতুন দল গড়েই ৫৪ আসনে জিতেছেন, হয়ে গেছেন প্রধান বিরোধী শক্তি। তামিল ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স পেয়েছে ১০টি আসন। আর বামপন্থী যে রাজনৈতিক দল গত নির্বাচনে ৬ আসনে জিতেছিল, এবার পেয়েছে মাত্র ৩টি।
রাজাপক্ষেদের এই বিপুল বিজয়ে আদতে কী হবে? বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিরোধী মত দমনের খ্যাতি রয়েছে, আছে দুর্নীতির অভিযোগ। তাঁর ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ আছে। এবারের নতুন সরকারে এই পরিবারের ক্ষমতায় থাকা আরও পোক্ত হওয়ায় শ্রীলঙ্কায় একটি অনুদার একনায়কধর্মী শাসনের প্রতিষ্ঠা স্রেফ সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিবিসির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাজাপক্ষেরা যেহেতু সিংহলি জাতীয়তাবাদকে সর্বাগ্রে অগ্রাধিকার দেবেন, সেহেতু শ্রীলঙ্কার মুসলিম, তামিল, খ্রিষ্টানসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ঝুঁকির মুখে পড়বে। পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া এসএলপিপি খুব সহজেই সংবিধান পরিবর্তন করে নিজেদের মতো সাজিয়ে নিতে পারবে। এতে করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার পরিসর কমানো, বিচার বিভাগের ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ গণতান্ত্রিক চর্চা বাড়ানোর লক্ষ্যে আগের সরকার যেসব সাংবিধানিক পরিবর্তন এনেছিল, সেগুলো খারিজ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে নতুন সরকার ক্ষমতায় এসেই অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে। নিক্কেই এশিয়ান রিভিউয়ে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, শ্রীলঙ্কা এরই মধ্যে ঋণের ফাঁদে আটকে গেছে। জনসাধারণের মোট ঋণ দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের প্রায় ৯০ শতাংশে পৌঁছে গেছে। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর ওপরে আছে নতুন করোনাভাইরাসের কারণে হওয়া অর্থনৈতিক ক্ষতি। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দেশটির অর্থনীতি ৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে। তবে নতুন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে তুলনামূলক বেশ সফল শ্রীলঙ্কা। সিএনএনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কায় করোনাভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা তিন হাজারের কম, মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবার কঠোর শাসনে বিশ্বাসী। এ ধরনের শাসনে স্বল্প মেয়াদে ভালো ফল পাওয়া গেলেও, দীর্ঘ মেয়াদে সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা ধ্বংস হয়ে যায়। অন্যদিকে ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ছিলেন মূলত চীন ঘেঁষা। ওই সময় শ্রীলঙ্কায় চীনের বিনিয়োগও ছিল প্রচুর। তবে এবার নির্বাচনে বিজয়ের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মাহিন্দাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এবার দুই পক্ষেই তাল মেলাতে পারেন মাহিন্দা। সেই সঙ্গে পুরো বিশ্বে একব্যক্তিকেন্দ্রিক ক্যারিশমেটিক নেতৃত্বের যে ধরন জনপ্রিয় হচ্ছে, তাতেও নাম লেখাতে পারেন তিনি।
শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট অধিবেশন শুরু হবে ২০ আগস্ট থেকে। শুরু হবে রাজাপক্ষে পরিবারের শাসনের নতুন অধ্যায়। এই শাসন কতটুকু সর্বগ্রাসী হয়, তাই এখন দেখার।