এএফপির বিশ্লেষণ

শ্রীলঙ্কায় রোষের মুখে ক্ষমতাধর রাজাপক্ষে পরিবার

মাহিন্দা রাজাপক্ষে
মাহিন্দা রাজাপক্ষে

তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এত খারাপ অবস্থায় আর পড়েনি দেশটি। এতে সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। তাদের রোষের মুখে দেশটির সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজাপক্ষে পরিবার।

চরম অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার প্রতিবাদে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাসভবনের সামনে গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে বিক্ষোভ শুরু করে শত শত মানুষ। বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢোকার চেষ্টা করে। এ সময় নিরাপত্তা বাহিনী গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। বিক্ষোভের পর শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় রাতেই কারফিউ জারি করা হয়। সহিংসতায় একজন আহত হয় এবং ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

রাজাপক্ষে পরিবার কয়েক দশক ধরে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করেছে। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হিসেবে ২০১৯ সালে দায়িত্ব নেন গোতাবায়া। গোতাবায়ার এক ভাই মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী, বাসিল রাজাপক্ষে অর্থমন্ত্রী। তাঁদের আরেক ভাই চামাল রাজাপক্ষেও মন্ত্রিসভার সদস্য। এই ভাইদের দুই ছেলে নামাল ও শশীন্দ্র রাজাপক্ষেও মন্ত্রিসভায় রয়েছেন। শ্রীলঙ্কার মতো এক পরিবারের শাসনের নজির এ অঞ্চলের ইতিহাসে বেশ বিরল।

গোতাবায়া রাজাপক্ষে

‘দলপ্রধান’

রাজাপক্ষে পরিবারের প্রধান ক্যারিশমাটিক নেতা হিসেবে মনে করা হয় মাহিন্দা রাজাপক্ষেকে (৭৬)। এর আগে ২০০৪ সালে তিনি এ পদে ছিলেন। ২০০৫ ও ২০১৫ সাল পর্যন্ত টানা ১০ বছর তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিন বছর আগে ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া তাঁকে আবার দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন।

মাহিন্দা রাজাপক্ষে মূলত সিংহল-বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে অধিক জনপ্রিয়। ২০০৯ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল বিদ্রোহীদের দমনে নৃশংস সামরিক পন্থা গ্রহণ করেছিলেন তিনি। এর মাধ্যমে দেশটিতে এক দশকের দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ রয়েছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে কথিত ‘গুলিবর্ষণ নিষিদ্ধ এলাকায়’ শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়। সেই সময় ক্ষমতায় থাকা মাহিন্দা রাজাপক্ষে এই নিহতের সংখ্যা অস্বীকার করেন এবং নৃশংসতার ওই অভিযোগ আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত করার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। সেখানে কয়েক দফা স্থানীয় অনুসন্ধানের পরও ওই অভিযোগের যথাযথ যুদ্ধাপরাধের তদন্ত বা বিচারকাজ শুরু করা যায়নি।

বাসিল রাজাপক্ষে

মাহিন্দার শাসনামলে শ্রীলঙ্কা আরও বেশি চীন–ঘনিষ্ঠ হয়েছে। চীনের কাছ থেকে অবকাঠামো প্রকল্পের জন্য ৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে দেশটি। এর অধিকাংশ দুর্নীতির কারণে অকার্যকর সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে।

সমালোচকেরা বলেন, গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও মাহিন্দা শ্রীলঙ্কার তামিলদের সঙ্গে বিভেদ দূর করতে তেমন কিছু করেননি। গৃহযুদ্ধে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণ করতেও তামিল বিদ্রোহী সম্প্রদায়ের বাধা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে।

‘দ্য টার্মিনেটর’

প্রেসিডেন্ট থাকাকালে মাহিন্দার প্রধান লেফটেন্যান্ট ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে (৭২)। প্রভাবশালী পদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকাকালে তিনি ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ওপর প্রভাব বিস্তার করেন।

গোতাবায়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুম করে ফেলার জন্য ‘ডেথ স্কোয়াডের’ কারিগর ছিলেন। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। নিজের পরিবারের কাছেই তিনি ‘দ্য টার্মিনেটর’ নামে পরিচিত। খুব দ্রুত মেজাজ হারান বলে প্রতিপক্ষও গোতাবায়াকে ভয় পায়। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি শ্রীলঙ্কার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকটের কেন্দ্রে রয়েছেন। ২০১৯ সালে গোতাবায়া যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তখন তিনি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বিপর্যস্ত অর্থনীতি পেয়েছিলেন। সন্ত্রাসী হামলা ও রাজনৈতিক সংকট দেশটির ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত করে। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই কাজে নেমে পড়েন গোতাবায়া। তাঁর সরকার বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড়তে শুরু করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়। কমে যায় কর আদায়। বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যায়।

চামাল রাজাপক্ষে

বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার মারাত্মক ঘাটতিতে অনেক পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে সরকার। ফলে প্রয়োজনীয় জিনিসের তীব্র ঘাটতি দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কায় বড় সমস্যা সন্ত্রাসবাদ। ২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে জঙ্গি হামলায় বড় ধাক্কা খায় দেশটি। এর চেয়েও বড় ধাক্কা দিয়েছে করোনা মহামারি। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ বলছেন, রাজাপক্ষে পরিবারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার জন্য বছরের পর বছর ধরে থাকা দীর্ঘস্থায়ী বাজেট ঘাটতি এবং নির্বিচার আয়করে কাটছাঁটও বর্তমান পরিস্থিতির জন্য দায়ী।

‘মি. টেন পারসেন্ট’

মাহিন্দা রাজাপক্ষের অধীনে অর্থনীতি সামলানো ও রাজনৈতিক কৌশল নিয়ে কাজ করা বাসিল রাজাপক্ষে (৭০) এখনকার অর্থমন্ত্রী। বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে ‘মিস্টার টেন পারসেন্ট’ বলা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি চুক্তি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। তবে বিভিন্ন প্রশাসনের করা তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে লাখ লাখ ডলার সরানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। গোতাবায়া প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়েছে।

নামাল রাজাপক্ষে

‘দ্য বডিগার্ড’

মাহিন্দা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তখন পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন চামাল রাজাপক্ষে (৭৯)। পরে তিনি নৌপরিবহন ও বিমানমন্ত্রী হন। বর্তমানে সেচ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছেন। বর্তমান সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারীও তিনি। তিনি আগে পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন। বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন চামাল।

ভবিষ্যৎ

রাজাপক্ষে পরিবারের ভবিষ্যৎ হিসেবে যাঁকে দেখা হচ্ছে, তিনি হলেন নামাল রাজাপক্ষে (৩৫)। আইনজীবী হিসেবে কাজ করা নামাল মাহিন্দা রাজাপক্ষের বড় ছেলে। ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নামালকে নিজের মতো করে গড়ে তুলছেন মাহিন্দা। ২০১০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে পার্লামেন্ট সদস্য হন নামাল। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার ক্রীড়া ও যুবমন্ত্রী তিনি। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো অর্জন তিনি না করলেও গত এক দশকে বাবার শাসনামলে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠেন নামাল। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তবে নামাল এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন।