শ্রীলঙ্কায় বিক্ষোভ-সহিংসতা দমনে গুলি করার নির্দেশ

# সংসদ সদস্যদের পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে বিমানবন্দরের সামনে বিক্ষোভকারীদের অবস্থান।
# মাহিন্দা রাজাপক্ষের ছোট ভাই গোতাবায়াকে প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার দাবি।
# নাশকতা ঠেকাতে নিরাপত্তা বাহিনীকে গুলি চালানোর ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর একটি তল্লাশি চৌকিতে সেনা সদস্যরা। ১০ মে, ২০২২
ছবি: এএফপি

শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়েও জনরোষ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না মাহিন্দা রাজাপক্ষে। বিক্ষুব্ধ হাজারো মানুষ ঢুকে পড়েছিলেন তাঁর সরকারি বাসভবনে। একপর্যায়ে পালিয়ে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ভবন ছাড়েন তিনি। পরে ঠাঁই নিয়েছেন একটি নৌঘাঁটিতে। ওই নৌঘাঁটির বাইরেও বিক্ষোভ চলছে।

মঙ্গলবারও কারফিউ ভেঙে রড-লাঠি হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন বিক্ষুব্ধ লোকজন। মাহিন্দার ছোট ভাই প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবি করছেন তাঁরা। বিরোধী দলগুলোও তাঁর পদত্যাগ দাবি করেছে।

গত সোমবার দুপুরে শুরু হওয়া সংঘর্ষ রাতে আরও বড় আকার ধারণ করে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ছাড়াও হাম্বানটোটায় তাঁদের পৈতৃক বাড়িতে হামলা হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় পারিবারিক জাদুঘর। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অর্ধশতাধিক বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এসব নেতার মধ্যে অনেক মন্ত্রী-এমপি রয়েছেন। এসব সহিংসতার ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত অন্তত আটজন নিহত এবং দুই শতাধিক মানুষ আহত হয়েছেন। এই সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ।

অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল শ্রীলঙ্কায় খাবার ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্যেরও সংকট দেখা দিয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনগণ এর জন্য সরকারকে দায়ী করছেন। সরকার পতনের দাবিতে এক মাসের বেশি সময় ধরে আন্দোলন চলছে। শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলন সহিংস রূপ নেয় সোমবার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের অনুসারীরা তাঁদের ওপর হামলা চালানোর পর। এরপর হাজার হাজার মানুষ রাজধানী কলম্বোসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেরিয়ে আসেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, সংসদ সদস্য এবং সাবেক–বর্তমান মন্ত্রীদের বাড়িতে হামলা চালান তাঁরা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর সমর্থকেরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসব বাসে করে কলম্বোয় এসেছিলেন, সেগুলো পুড়িয়ে দিচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা। মাহিন্দার দলের এক সংসদ সদস্যের গাড়ি ধাক্কা দিয়ে জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, মাহিন্দা রাজাপক্ষের দলের এক নেতাকে পেটানোর পর তাঁকে ময়লা ফেলায় ব্যবহৃত ঠেলাগাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তাঁর ব্যবহৃত গাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।

বিক্ষোভের আগুনে জ্বলছে শ্রীলঙ্কা

এই পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কাউকে সরকারি সম্পদ নষ্ট বা প্রাণঘাতী কিছু করতে দেখা গেলে তাঁকে থামাতে গুলি চালাতে পারবে নিরাপত্তা বাহিনী। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীর সদস্যরা কোনো বিক্ষোভকারীকে আটকের পর পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার আগে ২৪ ঘণ্টা নিজেদের হেফাজতে রাখতে পারবেন। একই সঙ্গে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যেকোনো বেসরকারি স্থাপনা ও গাড়িতে তল্লাশি চালাতে পারবেন। এদিকে কোনো পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তারের ক্ষমতা পেয়েছে পুলিশ।

বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে পাহারা

শ্রীলঙ্কার আইনপ্রণেতাদের দেশত্যাগ ঠেকাতে রাজধানী কলম্বোর বিমানবন্দরের প্রবেশমুখে অবস্থান নিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, একদল তরুণ কাতুনায়েকে মুক্ত বাণিজ্য এলাকার সড়কে অবস্থান নিয়েছেন। তাঁরা রাস্তায় আড়াআড়ি যানবাহন রেখে অবরোধ করেছেন। ওই সড়ক দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রধান বিমানবন্দর বন্দরনায়েক ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে যেতে হয়।

বিক্ষোভকারীরা বলছেন, মাহিন্দা রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়ার পর যাতে সংসদ সদস্যরা দেশ ছেড়ে পালাতে না পারেন, সে জন্য তাঁরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশমুখের সড়ক আটকে দিয়েছেন।

গোতাবায়ার পদত্যাগ দাবি

রাজাপক্ষে পরিবারের আর কাউকে সরকারে দেখতে চান না বিক্ষোভকারীরা। প্রেসিডেন্ট পদ থেকে মাহিন্দার ছোট ভাই গোতাবায়া রাজাপক্ষের পদত্যাগের দাবিতে মঙ্গলবারও বিক্ষোভ হয়েছে। এই দাবিতে কলম্বোয় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সামনে আবারও অবস্থান নিয়েছেন একদল বিক্ষোভকারী।

এদিকে চলমান সংকট নিরসনে সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রধান বিরোধী দল সামাজি জানা বালাবেগায়া (এসজেবি)। তবে তারাও গোতাবায়া রাজাপক্ষের প্রেসিডেন্ট পদ ছাড়ার শর্ত দিয়েছে। এসজেবির আইনপ্রণেতা হারসানা রাজাকারুনা বলেছেন, প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে ক্ষমতা ছাড়লে এসজেবি ক্ষমতা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাঁদের দলের অধিকাংশ সংসদ সদস্য এ প্রস্তাব দিয়েছেন।

যেভাবে পালালেন মাহিন্দা

মাহিন্দা রাজাপক্ষের প্রতি রোষ থেকে সোমবার কলম্বোয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন টেম্পল ট্রিজে ঢুকে পড়েন কয়েক হাজার বিক্ষোভকারী। সেখানে তাঁরা ভাঙচুর শুরু করেন। একপর্যায়ে দোতলা বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন। পুলিশ জানিয়েছে, সেখানে কমপক্ষে ১০টি পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করেন বিক্ষোভকারীরা।

এর আগে মাহিন্দার বাসার সামনে ওই বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিতে প্রথমে কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পুলিশ। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা সেখানে সামরিক বাহিনীর ব্যবহৃত একটি ট্রাকে আগুন ধরিয়ে দেন। এ ছাড়া টেম্পল ট্রিজের কাছে বিক্ষোভকারীদের হামলার শিকার হয়েছেন পুলিশের সিনিয়র ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল দেশবন্ধু টেনাকুন। বিক্ষোভকারীরা তাঁর গাড়িতেও আগুন ধরিয়ে দেন।

এই সহিংস পরিস্থিতির মধ্যে মঙ্গলবার ভোরে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে করে মাহিন্দা রাজাপক্ষে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ত্রিঙ্কোমালি শহরের একটি নৌঘাঁটিতে সরিয়ে নেওয়া হয়। এ খবর পেয়ে ওই নৌঘাঁটির বাইরে অবস্থান নেন বিক্ষোভকারীরা।

রাজনীতিকদের ঘর পোড়ানো হচ্ছে

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের পাশাপাশি দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের হাম্বানটোটায় গোতাবায়া ও মাহিন্দা রাজাপক্ষের পৈতৃক বাড়িতে ব্যাপক হামলা হয়েছে। সেখানে তাঁদের বাবার ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়েছে। পরিবারিক জাদুঘরেও হামলা হয়েছে। এ ছাড়া কুরুনেগালায় মাহিন্দার যে রাজনৈতিক কার্যালয় ছিল, সেটিও ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অর্ধ শতাধিক বাড়ি এবং এসব বাড়ির সামনে থাকা শতাধিক মোটরসাইকেল ও গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন একটি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়ার সময় একজন বিক্ষোভকারী বলেন, ‘এ ধরনের কাজ (পোড়ানো) আমাদের আরও আগেই করা উচিত ছিল। আমরা দুঃখিত যে কাজটি আগে করতে পারিনি।’

রাজাপক্ষের সমর্থকদের চিকিৎসা দিতে অনীহা

সোমবার সহিংসতায় আহত সরকার–সমর্থকদের চিকিৎসা দিতে রাজি ছিলেন না রাজধানীর প্রধান হাসপাতাল কলম্বো ন্যাশনাল হাসপাতালের অধিকাংশ চিকিৎসক। তাঁদের চিকিৎসা দেবেন না বলে হাসপাতালের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়েছিলেন তাঁরা। পরে সেনাসদস্যরা এসে ওই হাসপাতালের ফটক ভাঙেন। হাসপাতালের মুখপাত্র পুষ্পা সয়া বলেন, সংঘর্ষে আহত ২১৯ জনকে সেখানে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে।